মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
আক্বাবাহর বায়‘আত, ইসরা ও মিরাজ
আক্বাবাহর বায়‘আত, ইসরা ও মিরাজ
আক্বাবাহর ১ম বায়‘আত (দ্বাদশ নববী বর্ষ):
গত বছরে হজ্জের মওসুমে ইসলাম কবুলকারী ছয়জন যুবকের ব্যাপক প্রচারের ফলে পরবর্তী বছর নতুন সাত জনকে নিয়ে মোট বারো জন ব্যক্তি হজ্জে আসেন। দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহজ্জ মাসের (মোতাবেক জুলাই ৬২১ খৃঃ) এক গভীররাতে মিনার পূর্ব নির্ধারিত আক্বাবাহ নামক স্থানে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই স্থানটিকে এখন জামরায়ে আক্বাবাহ বা বড় জামরাহ বলা হয়।
এখানেই আইয়ামে তাশরীক্বের এক গভীর রাতে আলো- আঁধারীর মধ্যে আক্বাবাহর ১ম বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে মাদানী জীবনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বীজ বপন সমতুল্য।
এই বায়‘আতে জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) ব্যতীত গত বছরের বাকী পাঁচজন ছাড়াও এ বছরের নতুন সাতজন উপস্থিত ছিলেন। দুজন ছিলেন আওস গোত্রের এবং বাকীগণ ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।
বায়‘আত অনুষ্ঠান – (‘আক্বাবায়ে ঊলা):
বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের বললেন যে, তোমরা এসো আমার নিকটে বায়‘আত কর এই মর্মে যে,
(১) তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না
(২) চুরি করবে না
(৩) যেনা করবে না
(৪) নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না
(৫) কাউকে মনগড়া অপবাদ দিবে না
(৬) সঙ্গত বিষয়ে আমার অবাধ্যতা করবে না।
তোমাদের মধ্যে যারা এগুলি পূর্ণ করবে, আল্লাহর নিকটে তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি কেউ এগুলির কোনটি করে বসে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে সেটি তার জন্য কাফফারা হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ এগুলির কোনটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা ঢেকে রাখেন, তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপরেই ন্যস্ত থাকবে। চাইলে তিনি বদলা নিবেন, চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন।’ রাবী ওবাদাহ বিন ছামেত বলেন, অতঃপর আমরা উক্ত কথাগুলির উপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করলাম’।
গুরুত্ব:
বায়‘আতে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শুধু সেযুগেই নয়, বরং সর্বযুগেই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণিত বিষয়গুলি সমাজে ব্যপ্তি লাভ করলে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট হয়। জাহেলী আরবে এগুলি বিনষ্ট হয়েছিল বলেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এগুলি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। আজকালকের কথিত সভ্য দুনিয়ায় এগুলি প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে।
আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব দুনিয়াপূজারী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গতি আখেরাতমুখী করার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্র নেতাগণ আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে কাংখিত শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
বায়‘আতকারী নওমুসলিমদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একজন উদ্যমী ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবককে পাঠালেন শিক্ষক ও প্রচারক হিসাবে। যার নাম ছিল মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)।
মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-এর দাওয়াত:
১ম আক্বাবাহর বায়‘আত সম্পাদিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুছ‘আবকে তাদের সাথে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে তরুণ দলনেতা আবু উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর বাড়ীতে অবস্থান করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতের ফল এই হয়েছিল যে, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার সময়কালের মধ্যেই ইয়াছরিবের আনছারদের এমন কোন বাড়ী ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলমান হননি। তাঁর প্রচারকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-
একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সাথে নিয়ে বনু আব্দুল আশহাল ও বনু যাফরের (بنو ظفر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসলেন। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেয়ে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল- সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’। উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এক্ষুণি পালাও। তোমরা আমাদের বোকাগুলোকে মুসলমান বানাচ্ছো’।
মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছুটা পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমথ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর।’ এরপর তিনি সেখানেই ইসলাম কবুল করলেন।
অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে অন্যায় কিছু দেখিনি’। তবে আমি তাদের নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যাক। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহর লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব নিশ্চিন্তে বসে আছে।
বনু হারেছাহর হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধ স্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায় এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’।
আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হলে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’। অতঃপর তিনি বসলেন এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন। অতঃপর সেখানেই দুরাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে এলেন ও সবাইকে ডেকে বললেন, হে বনু আব্দুল আশহাল!
তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর? তারা বলল, ‘আপনি আমাদের নেতা, সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী ও নিশ্চিন্ততম কান্ডারী’। তখন তিনি বললেন, তোমাদের নারী ও পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনবে’। এ কথার প্রতিক্রিয়া এমন হল যে, সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ইসলাম কবুল করল। মাত্র একজন ব্যতীত।
যার নাম ছিল উছাইরাম (الأصيرم)। ইনি পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও শাহাদত বরণ করেন। কলেমায়ে শাহাদত পাঠ করা ব্যতীত আল্লাহর জন্য একটা সিজদা করারও সুযোগ তিনি পাননি। রাসূল (সাঃ) তার সম্পর্কে বলেন, ‘অল্প আমল করল ও পুরস্কার অধিক পেল’।
ইসরা ও মি‘রাজ (১৩ নববী বর্ষ):
মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বুরাক্বের সাহায্যে স্বল্পকালীন নৈশ ভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ থেকে ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশের সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকে মে‘রাজ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সূরা বনু ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ আয়াতে মি‘রাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। বাকী বিশদ ঘটনাবলী ছহীহ হাদীছ সমূহে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ-
‘পরম পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রির একাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তীনের) মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। যার চতুস্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি, যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)।
উক্ত আয়াতে চারটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে।
এক. ইসরা ও মিরা‘জের পুরা ঘটনাটি রাতের শেষাংশে স্বল্প সময়ে সম্পন্ন হয়েছিল, যা ليلاً শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে।
দুই. ঘটনাটি সশরীরে ঘটেছিল, যা بعبده শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে। কেননা রূহ ও দেহের সমন্বিত সত্তাকে ‘আব্দ’ বা দাস বলা হয়। স্বপ্নযোগে বা রূহানী ব্যাপার হলে কেউ একে অবিশ্বাস করত না এবং কুরআনে তাঁকে ‘আব্দ’ না বলে হয়ত ‘রূহ’ (بروح عبده) বলা হত। এখানে عبده ‘তাঁর দাস’ বলে রাসূলকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মক্কার কাফেররা প্রথমে বিশ্বাস করেনি, অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করল।
সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে তারা চুপ হল বটে। কিন্তু তাদের হঠকারী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত আবুবকর (রাঃ) জোরগলায় মে‘রাজের সত্যতার ঘোষণা দিতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশী হয়ে তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ (صديق) বা সর্বাধিক সত্যবাদী উপাধি দেন। এটি অত্যন্ত বড় বিষ্ময়কর ঘটনা ছিল।
তিন. বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর আশপাশ ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তীন সহ পুরা সিরিয়া অঞ্চল বরকতময় এলাকা, যা باركنا حوله বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে।
চার. আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শন সমূহের কিছু অংশ স্বচক্ষে দেখিয়ে দেন। যা لنريه من آياتنا বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। উক্ত নিদর্শন সমূহের মধ্যে ছিল মক্কা থেকে বুরাকে সওয়ার হওয়ার পূর্বে সীনা চাক করা এবং তা যমযম পানি দিয়ে ধৌতকরণ, অতঃপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে ঊর্ধারোহণের পূর্বে তাঁকে দুধ ও মদ পরিবেশন।
কিন্তু রাসূলের দুধ গ্রহণ, অতঃপর জিব্রীলের সাথে সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ, বিগত নবীদের সাথে মুলাক্বাত, জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন, সিদরাতুল মুনতাহায় একাকী আল্লাহর নিকটতম সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া এবং আল্লাহর সাথে সরাসরি কথোপকথন।
অতঃপর উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের উপঢৌকন নিয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাগমন এবং বিদায় কালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে ফজরের ছালাতে নবীগণের ইমামতি করণ ও তাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় বোরাক অশ্বে সওয়ার হয়ে রাত্রি কিছুটা বাকী থাকতেই মক্কায় প্রত্যাবর্তন।
হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। মে‘রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস এবং মে‘রাজের অমূল্য তোহ্ফা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করা। মে‘রাজ ছিল ইসলামী বিজয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং মাদানী জীবনের সূচক ঘটনা।
বায়‘আতে কুবরা (ত্রয়োদশ নববী বর্ষ):
দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ১ম বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সাথে রাসূলের প্রেরিত দাঈ মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর দিন-রাত প্রচারের ফলে পরের বছর ত্রয়োদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে (জুন ৬২২ খৃঃ) অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ২য় বায়‘আতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সহ মোট ৭৫ জন ইয়াছরিববাসী ইসলামের উপর বায়‘আত করেন।
এটিই ইতিহাসে বায়‘আতে কুবরা বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাদানী যিন্দেগীর ভিত্তি স্বরূপ এবং আগামীতে ঘটিতব্য ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনাকারী। এই সময় মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে ইয়াছরিবে দাওয়াতের অবস্থা এবং গোত্র সমূহের ইসলাম কবুলের সুসংবাদ প্রদান করেন। যা রাসূলকে হিজরতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়।
– একাদশ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহর নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর ১ম বায়‘আত।
– দ্বাদশ বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং
– ত্রয়োদশ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত-
– যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূলের হিজরতের সূত্রপাত হয়।
ঘটনা:
১২ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় পূর্বোক্ত ৭৫ জন ইয়াছরেবী হাজী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাক্ষাতের জন্য বের হন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্বাবাহর সুড়ঙ্গ পথে অতি সঙ্গোপনে হাযির হন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় চাচা আববাসকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, যিনি তখনও প্রকাশ্যে মুসলমান হননি।
কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রথমে আববাস কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে কিভাবে আছেন তোমরা জানো। তাকে আমরা আমাদের কওমের শত্রুতা থেকে হেফাযতে রেখেছি এবং তিনি ইযযতের সাথে তার শহরে বসবাস করছেন। এক্ষণে তিনি তোমাদের ওখানে হিজরত করতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তোমরা তার পূর্ণ যিম্মাদারীর অঙ্গীকার করলে আমাদের আপত্তি নেই।
কিন্তু যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে গেলে, অতঃপর বিপদ মুহূর্তে তাকে পরিত্যাগ করলে, তাহলে তোমরা তাকে নিয়ে যেয়ো না। তিনি আমাদের মধ্যে সসম্মানেই আছেন’।
আববাসের বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে কা‘ব বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! আমরা আববাসের কথা শুনেছি। এক্ষণে – আপনি কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য ও নিজ প্রভুর জন্য যে চুক্তি আপনি ইচ্ছা করেন, তা করে নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথমে কুরআন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান। অতঃপর তিনি বললেন,
‘আমি তোমাদের বায়‘আত নেব এ বিষয়ের উপরে যে, তোমরা আমাকে হেফাযত করবে ঐসব বিষয় থেকে, যেসব বিষয় থেকে তোমরা তোমাদের মহিলা ও সন্তানদেরকে হেফাযত করে থাক’। সাথে সাথে বারা বিন মা‘রূর রাসূলের হাত ধরে বললেন,
‘হাঁ! ঐ সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাকে হেফাযত করব ঐসব বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা আমাদের মা-বোনদের হেফাযত করে থাকি’। এ সময় আবুল হায়ছাম বিন তায়হাম বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সঙ্গে ইহুদীদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে। আমরা তা ছিন্ন করছি। কিন্তু এমন তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি। তারপর আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন তখন আপনি আবার আপনার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন ও আমাদের পরিত্যাগ করবেন।
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, ‘না! বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস। আমি তোমাদের এবং তোমরা আমাদের। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব’। এরপর লোকজন যখন বায়‘আত গ্রহণের জন্য এগিয়ে এলো,
তখন আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযলাহ সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কি জানো কোন কথার উপরে তোমরা এই মানুষটির নিকটে বায়‘আত করছ? সবাই বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তোমরা লাল ও কালো (আযাদ ও গোলাম) মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তার নিকটে বায়‘আত করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এরূপ ধারণা থাকে যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তার সঙ্গ ছেড়ে যাবে, তাহলে এখনই ছেড়ে যাও।
কেননা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমরা তাকে পরিত্যাগ কর, তাহলে ইহকাল ও পরকালে চরম লজ্জার বিষয় হবে। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের মাল-সম্পদ ধ্বংসের ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, যার প্রতি তোমরা তাঁকে আহবান করছ, তাহলে অবশ্যই তা সম্পাদন করবে। কেননা আল্লাহর কসম! এতেই তোমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে।’
আববাস বিন ওবাদাহর এই ওজস্বিনী ভাষণ শোনার পর সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমরা তাকে গ্রহণ করছি আমাদের মাল-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হত্যার বিনিময়ে। কিন্তু এর বদলায় আমাদের কি রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল!’ তিনি বললেন, জান্নাত। তারা বলল, হাত বাড়িয়ে দিন হে রাসূল! ‘ব্যবসা লাভজনক হয়েছে। আমরা কখনো তা রহিত করব না বা রহিত করার আবেদন করব না’।
এ সময় দলনেতা এবং কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আস‘আদ বিন যুরারাহ পূর্বের বক্তার ন্যায় কথা বললেন এবং পূর্বের ন্যায় সকলে পুনরায় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন, অতঃপর তিনিই প্রথম বায়‘আত করলেন। এরপর একের পর এক সকলে রাসূলের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।
মহিলা দু’জনের বায়‘আত হয় মৌখিক অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবতী এই মহিলা দু’জন হ’লেন উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবা বিনতে কা‘ব (أم عمارة نسيبة بنت كعب) এবং উম্মে মানী‘ আসমা বিনতে আমর (أم منيع أسماء بنت عمرو) । প্রথম জন ছিলেন বনু মাঝেন গোত্রের এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন বনু সালামা গোত্রের।
বায়‘আতের কথা শয়তান ফাঁস করে দিল:
ইবলীস শয়তান এই বায়‘আতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল বুঝতে পেরে দ্রুত পাহাড়ের উপরে উঠে তার স্বরে আওয়ায দিল হে তাঁবুওয়ালারা! মুহাম্মাদ ও তার সাথী বিধর্মীদের ব্যাপারে তোমাদের কিছু করার আছে কি? তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্রিত হয়েছে’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, – এটা সুড়ঙ্গের শয়তান। হে আল্লাহর দুশমন।
অতি সতবর আমি তোর জন্য বেরিয়ে পড়ছি’। একথা শুনে আববাস বিন উবাদাহ বিন ওবাদাহ বিন নাযলাহ (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘হে রাসূল! সেই সত্তার কসম করে বলছি যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আপনি চাইলে আগামী কালই আমরা মিনাবাসীদের উপরে তরবারি নিয়ে হামলা চালাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আমরা সেজন্য আদিষ্ট হইনি’। তোমরা স্ব স্ব তাঁবুতে ফিরে যাও (আর-রাহীক্ব)।
শয়তানের এই তির্যক কণ্ঠ কুরায়েশ নেতাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করার সাথে সাথে তারা ছুটে এল এবং ইয়াছরেবী কাফেলার লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা খুব গোপনে রাতের অন্ধকারে ঘটেছে, তাই খাযরাজ নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইসহ সকলে অজ্ঞতা প্রকাশ করল। এতে নেতারা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেল। কিন্তু তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে না পেরে পুনরায় এলো। কিন্তু তখন কাফেলা মদীনার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সা‘দ বিন ওবাদাহ ও মুনযির বিন আমর পিছনে পড়েন।
পরে মুনযির দ্রুত এগিয়ে গেলে সা‘দ ধরা পড়ে যান। কুরায়েশরা তাকে পিছনে শক্ত করে হাঁত বেধে মক্কায় নিয়ে আসে। কিন্তু মুত্ব‘ইম বিন আদী ও হারেছ বিন হারব বিন উমাইয়া এসে তাঁকে ছাড়িয়ে নেন। কেননা তাদের বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পথে সা‘দের আশ্রয়ে থেকে যাতায়াত করত। এদিকে যখন ইয়াছরেবী কাফেলা তার মুক্তির ব্যাপারে পরামর্শ করছিল, ওদিকে তখন সা‘দ নিরাপদে তাদের নিকটে পৌঁছে গেলেন।
অতঃপর তারা সকলেই নির্বিঘ্নে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। এই ঐতিহাসিক বায়‘আতকে স্বাগত জানিয়ে আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূলের নিকটে আয়াত নাযিল করে বলেন,
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقّاً فِي التَّوْرَاةِ وَ الإِنجِيْلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِيْ بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মুসলমানদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর মারে ও মরে। এই সত্য প্রতিশ্রুতি রয়েছে তওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে। আর আল্লাহর চাইতে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর সেই লেন-দেনের উপরে যা তোমারা করেছ তার সাথে। আর এ হ’ল এক মহান সাফল্য’। [তওবাহ ৯/১১১]