মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
মদীনায় হিজরত এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে হত্যার ষড়যন্ত্র
মদীনায় হিজরত এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে হত্যার ষড়যন্ত্র
ছাহাবীগণের ইয়াছরিবে কষ্টকর হিজরত শুরু:
বায়‘আতে কুবরা সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্যাতিত মুসলমানদের ইয়াছরিবে হিজরতের অনুমতি দিলেন। মক্কার কাফেররা ইয়াছরিবে হিজরতে বাধা দিতে থাকল। ইসলামের প্রসার বৃদ্ধিতে বাধা দেওয়া ছাড়াও এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক।
অর্থনৈতিক কারণ ছিল এই যে, মক্কা থেকে ইয়াছরিব হয়ে সিরিয়ায় তাদের গ্রীষ্মকালীন ব্যবসা পরিচালিত হত। এ সময় সিরিয়ায় তাদের বার্ষিক ব্যবসার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ দীনার। এছাড়াও ছিল ত্বায়েফ-এর ব্যবসা। উভয় ব্যবসার জন্য যাতায়াতের পথ ছিল ইয়াছরিব। আল্লাহ পাক এমন এক স্থানে নির্যাতিত মুসলমানদের হিজরতের ব্যবস্থা করেন, যা হয়ে ওঠে এক অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমি।
এই হিজরতের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল এই যে, ইয়াছরিবে মুহাজিরগণের অবস্থান সুদৃঢ় ে এবং ইয়াছরিববাসীগণ ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিলে তা মক্কার মুশরিকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে। ফলে তা মক্কাবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। যাতে তাদের জান-মাল ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু হুমকির মধ্যে পড়বে। হযরত আবুবকর (রাঃ) হিজরতের মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে নিষেধ করে বলেন, ‘থেমে যাও! আমি আশা করছি যে, আমাকেও অনুমতি দেওয়া হবে’। এভাবে রাসূল, আবুবকর ও আলী ব্যতীত মক্কায় আর কোন মুসলমান অবশিষ্ট থাকলেন না।
রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র কুরায়েশ নেতারা বায়‘আতে কুবরা-র প্রায় আড়াই মাস পর চতুর্দশ নববী বর্ষের ২৬শে ছফর মোতাবেক ১২ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খৃষ্টাব্দ বৃহস্পতিবার দিনের প্রথম ভাগে তাদের অবিসংবাদিত সাবেক কুরায়েশ নেতা কুছাই বিন কিলাব প্রতিষ্ঠিত বৈঠক ঘর দারুন নাদওয়াতে কুরায়েশ-এর অধিকাংশ গোত্রনেতাদের এক যরূরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য যে, এই বৈঠকে রাসূলের গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবকে ডাকা হয়নি। কুরায়েশ সাত গোত্রের ১৪ জন নেতা দারুন নাদওয়াতে পূর্বাহ্নে বসে আলোচনা শুরু করে। আবু জা প্রস্তাব দিয়ে বলল, প্রতি গোত্র থেকে একজন করে সুঠামদেহী যুবক বাছাই করে তাদেরকে তরবারি দেওয়া হৌক। অতঃপর তারা এসে একসাথে আঘাত করে তাকে শেষ করে দিক। এতে তিনটা লাভ হবে।
এক. আমরা তার হাত থেকে বেঁচে যাব।
দুই. তার গোত্র আমাদের সব গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহস করবে না।
তিন. একজনের রক্তমূল্য বাবদ একশত উট আমরা সব গোত্র ভাগ করে দিয়ে দেব। যা কারু জন্য কষ্টকর হবে না’।
আবু জাের এই প্রস্তাবকে সকলে সানন্দে কবুল করল এবং এর উপরেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সবাই নিষ্ক্রান্ত হ’ল।
ষড়যন্ত্রকারী ১৪ জন নেতার পরিণতি : উপরোক্ত ১৪ জন নেতার মধ্যে ১১ জন মাত্র দু’বছর পরে ২য় হিজরীর ১৭ রামাযানে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে একদিনেই নিহত হয়। বাকী তিনজন জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম, হাকীম বিন হেযাম ও আবু সুফিয়ান ইবনু হারব পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে যান। আল্লাহ বলেন,
إِنَّهُمْ يَكِيدُوْنَ كَيْداً، وَأَكِيدُ كَيْداً-
‘তারা জোরালো কৌশল করেছিল। আর আমিও কৌশল করি’। ‘অতএব কাফেরদের … কিছুদিনের জন্য অবকাশ দিন’ (ত্বারেক ৮৬/১৫-১৭)।
রাসূলের গৃহ অবরোধ ও হিজরত:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার নির্দয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর নেতারা সারা দিন প্রস্ত্ততি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা অন্ধকার রাতে এসে চারদিক থেকে বাড়ী ঘেরাও করে ফেলে। যাতে মধ্য রাত্রির পরেই হামলা করে নবীকে ঘুমন্ত অবস্থায় শেষ করে দেয়া যায়। এই অবরোধ কার্যে সশরীরে অংশ নেয় মোট ১১ জন।
আল্লাহর কৌশল:
কাফেররা তাদের কৌশলে পাকাপোক্ত ছিল। ওদিকে আল্লাহর কৌশল ছিল অন্যরূপ। যেমন তিনি বলেন,
وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيُثْبِتُوْكَ أَوْ يَقْتُلُوْكَ أَوْ يُخْرِجُوْكَ وَيَمْكُرُوْنَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِيْنَ-
‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন কাফেররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল এজন্য যে, তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে অথবা বিতাড়িত করবে। এভাবে তারা নিজেদের ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল, আর আল্লাহ স্বীয় কৌশল করছিলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হ’লেন শ্রেষ্ঠ কেŠশলী’ (আনফাল ৮/৩০)।
পূর্বাহ্নে যখন দারুন নাদওয়াতে রাসূলকে হত্যার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখনই জিব্রীল মারফত রাসূলকে তা জানিয়ে দেওয়া হয় এবং রাতে নিজ শয্যায় ঘুমাতে নিষেধ করা হয়। এতেই হিজরতের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুপুরেই আবুবকর (রাঃ)-এর গৃহে তাশরীফ আনেন এবং হিজরতের সময়-সূচী ও অন্যান্য আলোচনা সম্পন্ন করেন। সেমতে আবুবকর (রাঃ) পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। রাত্রি বেলায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুতে বলেন এবং তাঁর নিকটে রক্ষিত প্রতিবেশীদের আমানত সমূহ যথাস্থানে ফেরত দেবার দায়িত্ব দেন।
হিজরত শুরু:
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মধ্যরাতের সামান্য পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এবং শত্রুদের মাথার উপরে এক মুঠি কংকরযুক্ত মাটি ছড়িয়ে দিলেন সূরা ইয়াসীনের ৯নং আয়াতটি পাঠ করে (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬)। যেখানে বলা হয়েছে,
وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدّاً وَّمِنْ خَلْفِهِمْ سَدّاً فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ-
‘আর আমরা তাদের সম্মুখে ও পিছনে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করালাম। অতঃপর তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেললাম। ফলে তারা দেখতে পেল না’ (ইয়াসীন ৩৬/৯)।
তিনি নির্বিঘ্নে বেরিয়ে এসে আবু বকরের গৃহে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর তাকে নিয়ে উত্তরমুখী ব্যস্ত পথ ছেড়ে দক্ষিণ মুখী ইয়ামানের পথ ধরে পদব্রজে যাত্রা করলেন। অতঃপর মক্কার দক্ষিণ-পূর্বে ৩ কি:মি: দূরত্ব পাড়ি দিয়ে অন্ধকার থাকতেই ছওর পাহাড়ে পৌছে গেলেন। অতঃপর পাহাড়ের পাদ দেশে পৌঁছে আবুবকর রাসূলকে কাঁধে উঠিয়ে নেন ও ধারালো পর্বতগাত্র বেয়ে উঠে খাড়া পাহাড়টির শীর্ষদেশে একটি গুহা মুখে উপনীত হন।
যাতে তার দু’পা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। আবুবকর প্রথমে একাকী অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করে অতিরিক্ত একটি কাপড় ছিঁড়ে ছোট ছোট ছিদ্র মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। তারপর রাসূলকে ভিতরে ডেকে নিলেন। এই গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে ছওর’ নামে পরিচিত। সেখানে তাঁরা শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার তিনদিন তিন রাত অবস্থান করেন।
গৃহ থেকে গুহা- কিছু ঘটনাবলী:
(১) অবরোধকারীদের প্রতিক্রিয়া : রাসূলের গৃহ অবরোধকারীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় প্রহর গুণছে মধ্যরাত্রি পার হওয়ার। ওদিকে তার আগেই রাসূল (সাঃ) তাদের সামনে দিয়ে চলে গেছেন। অথচ ওরা টেরই পায়নি। সকাল পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করল। কিন্তু পরে তারা আলীকে দেখে হতাশ হয়ে গেল। রাগে ও ক্ষোভে তারা আলীকে মারতে মারতে কা‘বা গৃহ পর্যন্ত নিয়ে কিছু সময় আটকে রেখে পরে ছেড়ে দেয়।
এরপর তারা আসে আবু বকরের গৃহে। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে না পেরে নরাধম আবু জা ছোট্ট মেয়ে আসমা বিনতে আবুবকরের মুখে এমন জোরে চপেটাঘাত করে যে, তার কানের দুল ছিঁড়ে পড়ে যায় এবং কানের লতি ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়।
(২) মক্কা ত্যাগকালে রাসূলের প্রতিক্রিয়া : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন মক্কার জনবসতি ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা নগরী! দুনিয়ার সমস্ত নগরীর চাইতে তুমিই আমার কাছে অধিক প্রিয়। যদি মক্কার লোকেরা আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করতাম না’। এই সময় যে আয়াতটি নাযিল হয় তা নিম্নরূপ-
وَكَأَيِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ هِيَ أَشَدُّ قُوَّةً مِّنْ قَرْيَتِكَ الَّتِيْ أَخْرَجَتْكَ أَهْلَكْنَاهُمْ فَلاَ نَاصِرَ لَهُمْ-
‘যে জনপদ তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চাইতে কত শক্তিশালী জনপদকে আমরা ধ্বংস করেছি। অতঃপর তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৩)।
(৩) গুহার মুখে শত্রু দল : রাসূলকে না পেয়ে কোরায়েশ নেতারা চারিদিকে অনুসন্ধানী দল পাঠায় এবং ঘোষণা করে দেয় যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও আবুবকরকে বা দুজনের কাউকে জীবিত বা মৃত ধরে আনবে তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে।
সন্ধানী দল এক সময় ছওর গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছে। এমনকি আবুবকর (রাঃ) তাদের পা দেখতে পান। তাদের কেউ নীচের দিকে তাকালেই তাদের দেখতে পেত। ফলে তিনি রাসূলের জীবন নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েন। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاَ تحزن إن الله معنا ‘দুঃখিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে-
إِلاَّ تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَار إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌِ-
‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় ‘সাকীনাহ’ (প্রশান্তি) নাযিল করলেন এবং তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথা সদা সমুন্নত। আল্লাহ েন পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ঐ সময়ের ঐ নাযুক অবস্থায় ‘দুঃখিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ এই ছোট্ট কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণ রূপে কায়মনোচিত্তে আল্লাহর উপরে নিজেকে সোপর্দ করে দেন।
গুহা থেকে মদীনা:
তিনদিন ধরে খোঁজাখুজির পর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে কাফেররা একপ্রকার রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। আব্দুল্লাহর (আবুবকরের (রাঃ) পুত্র) মাধ্যমে সব খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবার ইয়াছরিব যাত্রার নির্দেশ দিলেন। এজন্য আবুবকর (রাঃ) পূর্বেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। দুটি হৃষ্ট-পুষ্ট উট তিনি ঠিক করেছিলেন।
তাছাড়া রাস্তা দেখানোর জন্য দক্ষ পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীক্বত লায়ছীকে উপযুক্ত মজুরীর মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। যদিও সে তখন কাফেরদের দলভুক্ত ছিল। চুক্তি মতে সে চতুর্থ রাত্রিতে দুটি উট নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত । একটি উটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) এবং অন্যটিতে গোলাম আমের বিন ফুহায়রা ও পথপ্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীক্বত সওয়ার েন।
পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ ইয়াছরিব যাওয়ার পরিচিত পথ ছেড়ে লোহিত সাগরের উপকূলের দিকে ইয়ামনের পথ ধরে চললেন। অতঃপর এমন এক পথে গেলেন, যে পথের সন্ধান সাধারণভাবে কেউ জানত না।
★★★ ছওর গুহা থেকে মদীনা:
পথিমধ্যের কিছু ঘটনা:
(১) যাত্রাবস্থায় আবুবকর (রাঃ) সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিছনে বসেন। কেননা আবুবকরের মধ্যে বার্ধক্যের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূলের চেহারা-ছূরতে তখনো ছিল যৌবনের চাকচিক্য। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরববী ভেবে আবু বকরকেই করতো। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন, এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’। [5] এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন লোক হবে। এর দ্বারা তিনি রাসূলের পরিচয় গোপন করতেন।
(২) উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে : খোযা‘আহ গোত্রের খ্যাতনাম্নী অতিথিপরায়ণ মহিলা উম্মে মা‘বাদের খীমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পানাহারের কিছু আছে কি-না? ঐ মহিলার অভ্যাস ছিল তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন এমন হয়েছিল যে, বাড়ীতে পানাহারের মত কিছুই ছিল না।
ঐ সময়টা ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। বকরীগুলো সব মাঠে নিয়ে গেছে স্বামী আবু মা‘বাদ। একটা কৃশ দুর্বল বকরী যে মাঠে যাওয়ার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা তাঁবুর এক কোনে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেটাকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মে মা‘বাদ বললেন, ওর পালানে কিছু থাকলে আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বকরীটির বাঁটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখলেন ও বরকতের দো‘আ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরীটির পালান দুধে পূর্ণ হয়ে গেল।
তারপর তিনি দোহন করতে থাকলেন। তাতে দ্রুত পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথমে বাড়ীওয়ালী উম্মে মা‘বাদকে পান করালেন। তারপর সাথীদের এবং সবশেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে পান করলেন। এরপরে এক পাত্র পূর্ণ করে উম্মে মা‘বাদের কাছে রেখে তারা পুনরায় যাত্রা করলেন। অল্পক্ষণ পরেই আবু মা‘বাদ বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো- ‘আল্লাহর কসম! ইনিতো কুরায়েশদের সেই মহান ব্যক্তি। যাঁর সম্পর্কে লোকেরা বিভিন্ন কথা বলে থাকে। আমার দৃঢ় ইচ্ছা আমি তার সাহচর্য বরণ করি এবং সুযোগ পেলে আমি তা অবশ্যই করব’।
(৩) সুরাক্বা বিন মালেকের পশ্চাদ্ধাবন : বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাকা বিন মালেক বিন জু‘শুম জনৈক ব্যক্তির কাছে রাসূল গমনের সংবাদ শুনে পুরস্কারের লোভে দ্রুতগামী ঘোড়া ও তীর-ধনুক নিয়ে রাসূলের পিছে ধাওয়া করল। কিন্তু কাছে যেতেই ঘোড়ার পা দেবে গিয়ে সে চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। তখন তীর ছুঁড়তে গিয়ে তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না।
ইতিমধ্যে মুহাম্মাদী কাফেলা অনেক দূরে চলে গেল। সে পুনরায় ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু এবারও একই অবস্থা । কাছে পৌঁছতেই ঘোড়ার পা এমনভাবে দেবে গেল যে, তা আর উঠাতে পারে না। আবার সে তীর বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু আগের মতই ব্যর্থ । তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। তখনই তার মনে ভয় উপস্থিত হল এবং এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, মুহাম্মাদকে নাগালে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন রাসূলের নিকটে নিরাপত্তা প্রার্থনা করল। এ আহবান শুনে মুহাম্মাদী কাফেলা থেমে গেল।
সে কাছে গিয়ে রাসূলকে কিছু খাদ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্র দিতে চাইল। রাসূল (সাঃ) কিছুই গ্রহণ করলেন না। সুরাকা বলল, আমাকে একটি ‘নিরাপত্তা নামা’ (كتاب أمن) লিখে দিন। তখন রাসূলের হুকুমে আমের বিন ফুহায়রা একটি চামড়ার উপরে তা লিখে দিলেন। অতঃপর রওয়ানা হলেন।[8]লাভ হল এই যে, ফেরার পথে সুরাকা অন্যান্যদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যারা রাসূলের পিছু নিয়েছিল। এভাবে দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল রক্ত পিপাসু দুশমন, দিনের শেষভাগে সেই হল দেহরক্ষী বন্ধু।
সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-কেনানী যখন তার রাবেগ এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমার অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন তোমার হাতে কিসরার মূল্যবান কংকন পরানো হবে? [9] বস্ত্ততঃ ওহোদ যুদ্ধের পরে সুরাক্বাহ মুসলমান হন। অতঃপর ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে যখন মাদায়েন বিজিত হয় এবং পারস্য সম্রাট কিসরার রাজমুকুট ও অমূল্য রত্নাদি তাঁর সম্মুখে আনা হয়, তখন তিনি সুরাকাকে আহবান করেন।
অতঃপর তার হাতে কিসরার কংকন পরিয়ে দেন। এ সময় তার যবান থেকে বেরিয়ে যায়- আল্লাহু আকবর! আল্লাহর কি মহত্তব যে, সম্রাট কিসরার কংকন আজ বেদুইন সুরাকার হাতে শোভা পাচ্ছে’। [10] সুরাক্বা বিন মালেক যখন পিছু পিছু আসছিল, তখন আবুবকর ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاتحزن إن الله معنا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। [11] এতে বুঝা যায় যে, উক্ত সান্ত্বনা বাক্যটি কেবল ছওর গিরিগুহায় নয়, অন্যত্র সংকটকালেও তিনি বলেছিলেন। ছওর গুহা থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে ঘটনাটি ঘটেছিল।
(৪) বুরাইদা আসলামীর ইসলাম গ্রহণ : এরপর পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন।
কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে কিছু কথাবার্তাতেই তার মনে দারুণ রেখাপাত করে এবং সেখানেই তার সত্তর জন সাথী সহ ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর মাথার পাগড়ী খুলে বর্শার মাথায় বেঁধে তাকে ঝান্ডা বানিয়ে ঘোষণা বাণী প্রচার করতে করতে চললেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তার বাদশাহ আগমন করেছেন। দুনিয়া এখন ইনছাফ ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে’।
(৫) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সাথে সাক্ষাত : পরবর্তী পর্যায়ে ছাহাবী যোবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে মদীনায় ফিরে আসছিলেন। ইনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-কে এক সেট করে সাদা কাপড় প্রদান করেন। যোবায়ের ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর জামাতা এবং আসমা (রাঃ)-এর স্বামী এবং আশারায়ে মুবাশ্শারাহর অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মহাবীর ছাহাবী ও মা আয়েশার পালিতপুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের স্বনামধন্য পিতা।
ক্বোবায় অবতরণ:
একটানা আটদিন চলার পর ১৪ নববী বর্ষের ৮ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে ক্বোবা। উপশহরে শ্বেত-শুভ্র বসন পরিহিত অবস্থায় তাঁরা অবতরণ করেন। এইদিন রাসূলের বয়স ৫৩ বছর পূর্ণ হয়। কোবায় মানুষের ঢল নামে। হাজারো মানুষের অভ্যর্থনার মধ্যেও রাসূল (সাঃ) ছিলেন চুপচাপ। তাঁর উপরে হযরত আবুবকর চাদর দিয়ে ছায়া করলে লোকেরা রাসূলকে চিনতে পারে। এ সময় তাঁর উপরে ‘অহি’ নাযিল হয়-
فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلاَهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلاَئِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيْرٌ-
জেনে রেখ, আল্লাহ, জিব্রীল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ তার সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী’। [12]
এদিকে হযরত আলীও মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে গচ্ছিত আমানত সমূহ স্ব স্ব মালিককে ফেরত দানের পর মদীনায় চলে আসেন এবং রাসূলের সাথে কুলছূম বিন হাদামের বাড়ীতেই অবস্থান করতে থাকেন। তিনি সোমবারে কোবায় অবতরণ করেন এবং শুক্রবারে সেখান থেকে ইয়াছবিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ সময়ে তিনি সেখানে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখানে ছালাত আদায় করেন।
অতঃপর তিনি ইয়াছরিবে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারকে সংবাদ দেন। বনু নাজ্জার ছিল খাযরাজ গোত্রভুক্ত। তারা সশস্ত্র প্রহরায় তাঁকে সাথে নিয়ে ইয়াছরিবের পথে যাত্রা করেন।
১ম জুম‘আ আদায়: ইয়াছরিবের উপকণ্ঠে পৌঁছে বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رَانُونَاء) উপত্যকায় ইসলামের ইতিহাসের ১ম জুম‘আ আদায় করেন। [13] যাতে একশত জন মুছল্লী শরীক ছিলেন। জুম‘আ পড়ে পুনরায় যাত্রা করে দক্ষিণ দিক থেকে তিনি ইয়াছরিবে প্রবেশ করেন। এদিন ছিল ১২ই রবীউল আওয়াল শুক্রবার। ইয়াছরিবের শত শত মানুষ তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়।
হযরত বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলের আগমনে আমি মদীনাবাসীকে যত খুশী হতে দেখেছি, এত খুশী তাদের কখনো হতে দেখিনি। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, هذا رسول الله قد جاء ‘এই যে, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন’। [14] উচ্ছ্বসিত মানুষ ঐদিন থেকে তাদের শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘মদীনাতুর রাসূল’ বা সংক্ষেপে মদীনা। এই সময় মদীনার ছোট ছোট মেয়েরা রাসূলকে স্বাগত জানিয়ে যে কবিতা পাঠ করে, তা ছিল নিম্নরূপ:
طلع البدر علينا + من ثنيات الوداع
ছানিয়াতুল বিদা টিলা সমূহ হ’তে আমাদের উপরে পূর্ণচন্দ্র উদিত হয়েছে।
وجب الشكرعلينا + مادعا لله داع
আমাদের উপরে শুকরিয়া ওয়াজিব হয়েছে, এজন্য যে, আহবানকারী (রাসূল) আল্লাহর জন্য (আমাদেরকে) আহবান করেছেন।
ايها المبعوث فبنا + جئت با لأمرالمطاع
হে আমাদের মধ্যে (আল্লাহর) প্রেরিত পুরুষ! আপনি এসেছেন অনুসরণীয় বিষয়বস্ত্ত (ইসলাম) নিয়ে। [15]
‘ছানিয়াহ’ অর্থ টিলা। মদীনায় লোকেরা তাদের মেহমানদেরকে নিকটবর্তী এই টিলা সমূহ পর্যন্ত এসে বিদায় জানাতো। এজন্য এই টিলা ‘ছানিয়াতুল বিদা’ বা বিদায়া দানের টিলা নামে পরিচিত হয়। ইয়াছরিবে প্রবেশের পর প্রত্যেক বাড়ীওয়ালা তার বাড়ীতে রাসূলকে মেহমান হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে উটের লাগাম ধরে টানতে থাকে।
কিন্তু উট নিজের গতিতে চলে বর্তমানের মসজিদে নববীর স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু রাসূল নামেননি। পরে উট পুনরায় উঠে কিছু দূর গিয়ে আবার সেখানেই ফিরে এসে বসে পড়ে। এটি ছিল রাসূলের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের স্থান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চেয়েছিলেন এখানে অবতরণ করে তার মামুদের বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে।
আবু আইয়ূবের বাড়ীতে অবতরণ : অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কার বাড়ী নিকটে? আবু আইয়ূব বললেন, ‘এই তো আমার বাড়ী, এইতো আমার দরজা।’ তখন রাসূল (সাঃ) তার বাড়ীতে গেলেন। আবুবকরও তাঁর সাথে গেলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দো‘আ করেন, ‘আল্লাহর বরকতের উপরে তোমরা দুজন (রাসূল ও আবুবকর) দাঁড়িয়ে যাও’। [16] এর মাধ্যমে তিনি সেখানে অবস্থান করার কথা ঘোষণা দেন।
নবী পরিবারের আগমন : কয়েক দিনের মধ্যেই নবীপত্নী হযরত সওদা বিনতে যাম‘আহ এবং নবীকন্যা উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা এবং উসামা বিন যায়েদ ও উম্মে আয়মন (উসামার আম্মা) মদীনায় পৌঁছে যান। এদের সকলকে আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর তার পারিবারিক কাফেলার সাথে নিয়ে এসেছিলেন। যাদের মধ্যে হযরত আয়েশাও ছিলেন। কেবল নবী কন্যা যয়নব তার স্বামী আবুল ‘আছের সঙ্গে রয়ে গেলেন। যারা বদর যুদ্ধের পরে চলে আসেন।
মদীনার আবহাওয়ার পরিবর্তন:
মদীনায় এসে মুহাজিরগণের অনেকে অসুখে পড়েন। হযরত আবু বকর (রাঃ) কঠিন জ্বরে কাতর হয়ে কবিতা পাঠ করেন, ‘প্রত্যেক মানুষকে তার পরিবারে ‘সুপ্রভাত’ বলে সম্ভাষণ জানানো হয়। অথচ মৃত্যু সর্বদা জুতার ফিতার চাইতে নিকটবর্তী’। বেলালও অনুরূপ বিলাপ ধ্বনি করে কবিতা পাঠ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এসব কথা রাসূলের কাছে তুলে ধরেন।
তখন তিনি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের নিকটে মদীনাকে প্রিয় করে দাও, যেমন মক্কা আমাদের প্রিয় ছিল। বরং তার চাইতে বেশী প্রিয়। তুমি মদীনাকে স্বাস্থ্যকর করে দাও, তার খাদ্য-শস্যে বরকত দাও এবং তার অসুখকে (রোগ-ব্যাধিকে) সরিয়ে দাও! বরং (দূরে) জোহফায় পৌঁছে দাও’। [17] ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় মদীনার অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হয়ে যায়।
আনছারগণের অপূর্ব ত্যাগ : আল্লাহ পাক ঈমানের বরকতে আনছারগণের মধ্যে এমন মহববত সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, মুহাজিরগণকে ভাই হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রত্যেকে লালায়িত ছিল। যদিও তাদের মধ্যে সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তারা ছিল প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। সবাই মুহাজিরগণকে স্ব স্ব পরিবারে পেতে চায়। অবশেষে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং মুহাজিরগণকে আনছারদের সাথে ভাই ভাই হিসাবে ঈমানী বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
তারা তাদের জমি, ব্যবসা ও বাড়ীতে তাদেরকে অংশীদার করে নেন। এমনকি যাদের দুই স্ত্রী ছিল, তারা এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে স্ত্রীহারা মুহাজির ভাইকে দিয়ে দেন। আনছারগণের এই ত্যাগ ও কুরবানীর প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,
وَيُؤْثِرُوْنَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَن يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ-
‘তারা নিজেদের উপরে মুহাজিরগণকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরা ছিল অভাবগ্রস্ত। বস্ত্ততঃ যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই হল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।
ফুটনোট:
[4] বুখারী হা/৩৯০৫।
[5] বুখারী হা/৩৯১১।
[6] যাদুল মা‘আদ ২/৫৩-৫৪।
[7] হাকেম ৩/৯-১০; ফিক্বহুস সীরাহ পৃ: ১৩১, আলবানী ছহীহ বলেছেন।
[8] বুখারী হা/৩৯০৬ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৪৫।
[9] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৬৯ ‘মাদায়েন বিজয়ের কাহিনী’।
[10] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৬৯ ‘মাদায়েন বিজয়ের কাহিনী’।
[11] বুখারী হা/৩৬৫২।
[12] তাহরীম ৬৬/৪, যাদুল মা‘আদ ৩/৫২; আর-রাহীক্ব পৃ: ১৭১।
[13] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/২১১।
[14] বুখারী হা/৪৯৪১ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[15] আর-রাহীক্ব পৃ: ১৭২; যঈফাহ হা/৫৯৮।
[16] বুখারী হা/৩৯১১।
[17] বুখারী হা/৫৬৭৭।