মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
হামযা ও ওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী ঘটনা
হামযা ও ওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী ঘটনা
হামযার ইসলাম গ্রহণ (৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে):
৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে যিলহাজ্জ মাসের কোন এক দিনে ছাফা পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় আবু জাহল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রথমে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করল। তাতে তাঁর কোন ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে আবু জাহল একটা পাথর ছুঁড়ে রাসূলের মাথায় আঘাত করল।
তাতে তাঁর মাথা ফেটে রক্ত ধারা প্রবাহিত হতে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নীরবে সবকিছু সহ্য করলেন। আবু জাহল অতঃপর কা‘বা গৃহের নিকটে গিয়ে তার দলবলের সাথে বসে উক্ত কাজের জন্য গৌরব যাহির করতে থাকল।
আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আনের জনৈক দাসী ছাফা পাহাড়ের উপরে তার বাসা থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করে। ঐ সময় হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব মৃগয়া থেকে তীর-ধনুকে সুসজ্জিত অবস্থায় ঘরে ফিরছিলেন। তখন উক্ত দাসীর নিকটে সব ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছুটলেন আবু জাহলের খোঁজে। তিনি ছিলেন কুরায়েশগণের মধ্যে মহাবীর ও শক্তিশালী যুবক। তিনি গিয়ে আবু জাহলকে মাসজিদুল হারামে পেলেন এবং তীব্র ভাষায় তাকে গালি দিয়ে বললেন,
‘হে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু নিঃসরণকারী (অর্থাৎ হে কাপুরুষ)! তুমি আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছ, অথচ আমি তার দ্বীনের উপরে আছি’? বলেই তার মাথায় ধনুক দিয়ে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, সে দারুণভাবে যখম হয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল। তখন আবু জাহলের বনু মাখযূম গোত্র এবং হামযার বনু হাশেম গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে চড়াও হল। এমতাবস্থায় আবু জাহল নিজের দোষ স্বীকার করে নিজ গোত্রকে নিরস্ত করল
। ফলে আসন্ন খুনোখুনি হতে উভয় পক্ষ বেঁচে গেল। বলা বাহুল্য, হামযার এই ইসলাম কবুলের ঘোষণাটি ছিল আকস্মিক এবং ভাতিজার প্রতি ভালোবাসার টানে। পরে আল্লাহ তার অন্তরকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন এবং তিনি নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য স্তম্ভরূপে আবির্ভূত হন।
ওমরের ইসলাম গ্রহণ:
হামযার ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরায়েশ বীর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। অবশ্য এটি ছিল রাসূলের বিশেষ দোআর ফসল। কেননা তিনি খাছভাবে দো‘আ করেছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ! ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব অথবা আমর ইবনু হেশাম (আবু জাহল) এই দুজনের মধ্যে তোমার নিকটে যিনি অধিকতর প্রিয় তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর। পরের দিন সকালে তিনি এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং কা‘বা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করলেন।
অতঃপর ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে প্রমাণিত হল যে, তিনিই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয়। ওমর ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ এবং পিতৃধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগ পোষণকারী। একই কারণে তিনি ছিলেন ইসলামের একজন বিপজ্জনক শত্রু। সে কারণেই একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তরবারি নিয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে নু‘আইম বিন আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে দেখা হল, যিনি তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। তিনি বলেন, কোথায় চলেছ ওমর? তিনি বললেন, ‘আমি এই বিধর্মী মুহাম্মাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি।
এ ব্যক্তি কুরায়েশদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে, তাদের ধর্মে দোষারোপ করেছে, তাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে। অতএব আমি তাকে হত্যা করব’। নু‘আইম বললেন, তাকে হত্যা করে বনু হাশেম ও বনু যোহরা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? ওমর বললেন, তুমিও দেখছি পূর্ব পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গেছ’? নু‘আইম বললেন, আমি কি তোমাকে একটি আশ্চর্যজনক খবর দেব না? ওমর বললেন, কি খবর? নু‘আইম বলল, ‘তোমার বোন ও ভগ্নিপতি বেদ্বীন হয়ে গেছে এবং তারা তোমার ধর্ম পরিত্যাগ করেছে’।
এতে ওমরের আত্মসম্মানে ঘা লাগলো এবং ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বোনের বাড়ীর দিকে ছুটলেন। হযরত খাববাব ইবনুল আরত ঐসময় ঘরের মধ্যে গোপনে স্বামী-স্ত্রীকে কুরআনের সূরা ত্বোয়াহা-এর তা‘লীম দিচ্ছিলেন। ওমরের পদশব্দে হতচকিত হয়ে তিনি ঘরের এক কোণে লুকিয়ে যান। ওমর ঘরে ঢুকে বললেন, শুনলাম তোমরা দু’জনে বেদ্বীন হয়ে গেছ? ভগ্নিপতি সাঈদ বললেন, ‘হে ওমর! যদি আপনার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে সত্য নিহিত থাকে, তবে সেবিষয়ে আপনার রায় কি’? একথা শুনে ওমর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ভগ্নিপতির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকলেন। তখন বোন (ফাতেমা) তাকে স্বামী থেকে পৃথক করে দিলেন।
এতে ওমর ক্ষিপ্ত হয়ে বোনের গালে জোরে চপেটাঘাত করলেন। তাতে বোনের মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বোন তেজস্বী কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হে ওমর! তোমার ধর্ম ছাড়া যদি অন্য ধর্মে সত্য থাকে? বলেই তিনি সোচ্চার কণ্ঠে কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করলেন (আর-রাহীক্ব) এবং বললেন, ‘আমরা ইসলাম কবুল করেছি এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। এক্ষণে তোমার যা খুশী কর’ (ইবনু হিশাম)। বোনের রক্তাক্ত চেহারা দেখে এবং তার মুখে এ দৃপ্ত সাক্ষ্য শুনে ওমরের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল।
তিনি লজ্জিত হলেন ও দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, তোমাদের কাছে যে পুস্তিকাটা আছে, ওটা আমাকে একটু পড়তে দাও’। বোন সরোষে বললেন, তুমি অপবিত্র। ঐ কিতাব পবিত্র ব্যক্তি ভিন্ন স্পর্শ করতে পারে না। ওঠ, গোসল করে এসো। ওমর তাই করলেন। অতঃপর কুরআনের উক্ত খন্ডটি হাতে নিয়ে সূরা ত্বোয়াহা পড়তে শুরু করলেন। যখন ১৪তম আয়াত পাঠ করলেন
إِنَّنِي أَنَا اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي-
‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। অতএব তুমি আমারই ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)।
এ আয়াত পাঠ করেই ওমর বলে উঠলেন, ‘কতই না সুন্দর ও কতই না মর্যাদাপূর্ণ এ বাণী? তোমরা আমাকে মুহাম্মাদ কোথায় বাৎলে দাও! ওমরের একথা শুনে খাববাব গোপন স্থান থেকে ত্বরিৎ বেরিয়ে এসে বললেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর হে ওমর! আমি আশা করি গত বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর রাসূল যে দো‘আ করেছিলেন তা তোমার শানে কবুল হয়েছে’। চল আল্লাহর রাসূল ছাফা পাহাড়ের পাদদেশের বাড়ীতে অবস্থান করছেন। যথাসময়ে কোষবদ্ধ তরবারি সহ ওমর সেখানে উপস্থিত হলেন।
তাঁকে তরবারিসহ দেখে হামযা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সবাই তাকে মোকাবিলার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। হামযা সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, তাকে স্বাচ্ছন্দে আসতে দাও। যদি সে সদিচ্ছা নিয়ে এসে থাকে তবে ভাল। নইলে তরবারি দিয়েই তার ফায়ছালা করা হবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ওমরের জামার কলার ও তরবারির খাপ ধরে জোরে টান দিয়ে বললেন, অলীদ বিন মুগীরাহ্র মত অপদস্থ ও শাস্তিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কি তুমি বিরত হবে না’? অতঃপর আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! এই যে ওমর! হে আল্লাহ তুমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মাধ্যমে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর’।
এই দো‘আর প্রভাব ওমরের উপরে এমনভাবে পড়ে যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল’। সাথে সাথে তিনি ইসলাম কবুল করলেন এবং আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও গৃহবাসী ছাহাবীগণ এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি করলেন যে, মসজিদুল হারাম পর্যন্ত সে আওয়ায পৌঁছে গেল’।
ওমরের ইসলাম পরবর্তী ঘটনা:
ইসলাম কবুলের পরপরই তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করলেন এবং তার মুখের উপরে বলে দিলেন যে, ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপরে ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন, আমি তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনেই আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে উঠল ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ, তার মন্দ করুন’। অতঃপর তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল।
এরপর ওমর গেলেন সে সময়ের সেরা মাউথ মিডিয়া জামীল বিন মা‘মার আল-জামহীর কাছে এবং তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি’। সে ছিল কুরায়েশ বংশের সেরা ঘোষক এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই সর্বত্র প্রচার করা হত। ওমর (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শোনামাত্র সে বেরিয়ে পড়ল। আর চিৎকার দিয়ে সবাইকে শুনাতে থাকল, ‘খাত্বাবের বেটা বিধর্মী হয়ে গেছে’। ওমর (রাঃ) তার পিছনেই ছিলেন। তিনি বললেন, ‘সে মিথ্যা বলছে। বরং আমি মুসলমান হয়েছি’।
একথা শোনা মাত্র চারিদিক থেকে লোক জমা হয়ে গেল এবং সকলে ওমরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট দুপুর পর্যন্ত চলল। এই সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে ওমর বলেন, যদি আমরা সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হতাম, তবে দেখতাম এরপরে মক্কায় তোমরা থাকতে, না আমরা থাকতাম’।
এই ঘটনার পর নেতারা ওমরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। ওমর (রাঃ) ঘরের মধ্যেই ছিলেন। এমন সময় তাদের গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ বনু সাহম গোত্রের জনৈক নেতা আছ ইবনে ওয়ায়েল সাহ্মী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়েছি বিধায় আপনার সম্প্রদায় আমাকে হত্যা করতে চায়’।
তিনি বলে উঠলেন, ‘কখনোই তা হবার নয়’। বলেই তিনি সোজা চলে গেলেন জনতার ভিড়ের সামনে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে জটলা করছ কেন? তারা বলল, ‘ইবনুল খাত্ত্বাব বিধর্মী হয়ে গেছে’। তিনি বললেন, ‘যাও! সেখানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই’। তার একথা শুনে লোকেরা ফিরে গেল। এরপর ওমর (রাঃ) রাসূলের খিদমতে হাযির হয়ে বললেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি হক-এর উপরে নই? তিনি বললেন, হাঁ। যার হাতে আমার জীবন, তার কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমরা সত্যের উপরে আছ যদি তোমরা মৃত্যুবরণ কর কিংবা জীবিত থাক’। তখন ওমর বললেন, তাহলে লুকিয়ে থাকার কি প্রয়োজন? যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তার কসম করে বলছি, অবশ্যই আমরা প্রকাশ্যে বের হব’। অতঃপর রাসূলকে মাঝখানে রেখে দুই সারির মাথায় ওমর ও হামযার নেতৃত্বে মুসলমানগণ প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে মসজিদুল হারামে উপস্থিত হলেন। বনু হাশিম ও বনু মুত্ত্বালিব গোত্রের প্রতি আবু ত্বালিবের আহবান :
হামযা ও ওমর (রাঃ)-এর পরপর মুসলমান হয়ে যাওয়ায় কুরায়েশরা দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইতিপূর্বে তারা মুহাম্মাদকে হত্যা করে তার রক্তের বিনিময়ে জনৈক উমারাহ বিন ওয়ালীদ নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে সমর্পণ করতে এসেছিল। ফলে হামযা ও ওমরের ইসলাম গ্রহণে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ ও সাহসের সঞ্চার হলেও দূরদর্শী ও স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিবের বুকটা ভয়ে সব সময় দুরু দুরু করত কখন কোন মুহূর্তে শয়তানেরা আকস্মিকভাবে মুহাম্মাদকে হামলা করে মেরে ফেলে।
দূরদর্শী ও স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিব সবদিক ভেবে একদিন স্বীয় প্রপিতামহ আবদে মানাফের দুই পুত্র হাশেম ও মুত্ত্বালিবের বংশধরগণকে একত্রিত করলেন। অতঃপর তাদের সামনে বললেন যে, এতদিন আমি এককভাবে ভাতিজা মুহাম্মাদের তত্ত্বাবধান করেছি। কিন্তু এখন এই চরম বার্ধক্যে ও প্রচন্ড বৈরী পরিবেশে আমার পক্ষে এককভাবে আর মুহাম্মাদের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভবপর নয়।
সেকারণ আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই’। গোত্র নেতা আবু ত্বালিবের এই আহবানে ও গোত্রীয় রক্তধারার আকর্ষণে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল এবং মুহাম্মাদের হেফাযতের ব্যাপারে সবাই একযোগে তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিল। একমাত্র চাচা আবু লাহাব বিরোধিতা করল এবং সে মুহাম্মাদের বিপক্ষ দলের প্রতি সমর্থন দানের ঘোষণা দিল।
বিরোধী পক্ষের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ:
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া পরপর চারটি ঘটনায় মুশরিক নেতাদের মধ্যে যেমন আতংক সৃষ্টি হয়, তেমনি মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। কারণগুলি ছিল যথাক্রমে-
(১) মুহাম্মাদকে প্রদত্ত লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ নাকচ হওয়া। অতঃপর উভয় দলের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদির কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জনের আপোষ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়া
(২) হামযার ইসলাম গ্রহণ ও সরাসরি আবু জাহলের উপরে হামলা করা
(৩) ওমরের ইসলাম গ্রহণ ও সরাসরি আবু জাহলের বাড়ীতে গিয়ে তার মুখের উপর তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ দেওয়া। অতঃপর মুসলমানদের মিছিল করে সর্বপ্রথম মসজিদুল হারামে আগমন ও প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান সমূহ পালন শুরু করা এবং
(৪) সবশেষে আবু তালিবের আহবানে সাড়া দিয়ে বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের মুসলিম-কাফির সকলের পক্ষ হতে মুহাম্মাদকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দানের অঙ্গীকার ঘোষণা করা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মুশরিক নেতৃবৃন্দ মুহাছছাব উপত্যকায় সমবেত হয় এবং বিস্তারিত আলোচনার পর বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব গোত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সর্বাত্মক বয়কট (৭ম নববী বর্ষের শুরুতে):
সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকলে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে যে,
(১) বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের সাথে বিয়ে-শাদী বন্ধ থাকবে
(২) তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও যাবতীয় লেন-দেন বন্ধ থাকবে
(৩) তাদের সাথে উঠাবসা, মেলা-মেশা, কথাবার্তা ও তাদের বাড়ীতে যাতায়াত বন্ধ থাকবে- যতদিন না তারা মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য তাদের হাতে তুলে দিবে। সপ্তম নববী বর্ষের ১লা মুহাররমের রাতে সম্পাদিত উক্ত অঙ্গীকারপত্রটি কা‘বা গৃহের ভিতরে টাঙিয়ে রাখা হল। উক্ত অঙ্গীকারনামার লেখক বুগায়েয (بغيض) বিন আমের বিন হাশেম-এর প্রতি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বদ দো‘আ করেন। ফলে তার হাতটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।
শে‘আবে আবু ত্বালিবে তিন বছর:
উপরোক্ত অন্যায় চুক্তি সম্পাদনের ফলে বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব উভয় গোত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিদারুণ কষ্টের সম্মুখীন হল। সঞ্চিত খাদ্যশস্য ফুরিয়ে গেলে তাদের অবস্থা চরমে ওঠে। ফলে তারা গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হন। নারী ও শিশুরা ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করত। তাদের ক্রন্দন ধ্বনি গিরি-সংকটের বাইরের লোকেরা শুনতে পেত। ফলে কেউ কেউ অতি সংগোপনে তাদের কাছে খাদ্য পৌঁছাতো। একবার হাকীম বিন হেযাম স্বীয় ফুফু খাদীজা (রাঃ)-এর নিকটে গম পৌঁছাতে গিয়ে আবু জাহলের হাতে ধরা পড়ে যান।
কিন্তু আবুল বুখতারীর হস্তক্ষেপে অবশেষে সমর্থ হন। হারামের চার মাস ব্যতীত অবরুদ্ধ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা বের হতে পারতেন না। অবশ্য যেসব কাফেলা বাহির থেকে মক্কায় আসত, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য-শস্য ক্রয়ে বাধা ছিল না। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মক্কার ব্যবসায়ীরা জিনিষপত্রের এমন চড়ামূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল যে, তা ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে আবু তালিবের দুশ্চিন্তা ছিল রাসূলের জীবন নিয়ে।
রাতের বেলা সকলে শুয়ে যাওয়ার পর তিনি রাসূলকে উঠিয়ে এনে তার বিশ্বস্ত নিকটাত্মীয়দের সাথে বিছানা বদল করাতেন। যাতে কেউ তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায়। উক্ত কঠোর অবরোধ চলাকালীন সময়েও হজ্জের মওসুমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বহির্দেশ থেকে আগত কাফেলা সমূহের তাঁবুতে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন। ওদিকে আবু লাহাব তাঁর পিছে পিছে গিয়ে লোকদেরকে তাঁর কথা না শোনার জন্য বলত।
অঙ্গীকারনামা ছিন্ন ও বয়কটের সমাপ্তি:
প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলল। ইতিমধ্যে মুশরিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও দ্বিধাবিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিল। যারা এই অন্যায় চুক্তিনামার বিরোধী ছিল, তারা ক্রমেই সংগঠিত হ’তে থাকল। বনু আমের বিন লুওয়াই গোত্রের হেশাম বিন আমরের উদ্যোগে যোহায়ের বিন আবী উমাইয়া ও মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীসহ পাঁচজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ‘হাজূন’ নামক স্থানে বসে এ ব্যাপারে একমত হন এবং তাঁদের পক্ষে যোহায়ের কা‘বা গৃহ তাওয়াফ শেষে প্রথম সরাসরি আবু জাহলের মুখের উপরে উক্ত চুক্তিনামা ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দেন। সাথে সাথে বাকী চারজন পরপর তাকে সমর্থন দেন। আবু জাহল বলল, বুঝেছি। তোমরা রাতের বেলা অন্যত্র পরামর্শ করেই এসেছ’।
ঐ সময়ে আবু ত্বালিব কা‘বা চত্বরে হাযির হলেন। তিনি কুরায়েশ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের চুক্তিনামা সম্পর্কে অবহিত করেছেন যে, ‘আল্লাহ ঐ অঙ্গীকারপত্রের উপরে কিছু কীট প্রেরণ করেছেন’। ‘অতঃপর তারা এর মধ্যকার যাবতীয় অন্যায়, বয়কট ও অত্যাচারমূলক কথাগুলো খেয়ে ফেলেছে, কেবল আল্লাহর নামগুলি ব্যতীত’।
অতঃপর আবু তবালেব নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে তোমাদের ও তার মধ্য থেকে আমরা সরে দাঁড়াব। আর যদি তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তোমরা আমাদের প্রতি বয়কট ও যুলুম থেকে ফিরে যাবে’। আবু ত্বালিবের এ সুন্দর প্রস্তাবে সকলে সমস্বরে বলে উঠল ‘আপনি ইনছাফের কথাই বলেছেন’।
ওদিকে আবু জাহল ও মুত্ব‘ইম এবং অন্যান্যদের মধ্যে বাকযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুত্ব‘ইম বিন আদী কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে অঙ্গীকারনামাটি ছিঁড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে বাইরে নিয়ে এলেন। দেখা গেল যে, সত্য সত্যই তার সব লেখাই পোকায় খেয়ে ফেলেছে কেবলমাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ (‘আল্লাহ তোমার নামে শুরু করছি’) বাক্যটি এবং অন্যান্য স্থানের আল্লাহর নামগুলি ব্যতীত।
এভাবে আবু ত্বালিবের মাধ্যমে প্রেরিত রাসূলের প্রাপ্ত অহীর সংবাদ সত্যে পরিণত হল। কুরায়েশ নেতারা অবাক বিস্ময়ে তা অবলোকন করল। অতঃপর অঙ্গীকার নামাটি মুত্ব‘ইম সর্বসমক্ষে ছিঁড়ে ফেললেন এবং এভাবে যথারীতি বয়কটের অবসান ঘটল ঠিক তিন বছরের মাথায় ১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে।