ভ্যানে কতজনের লাশ স্তূপ করেছিল পুলিশ, যাদের পরিচয় পাওয়া গেল (গুরুত্বপূর্ণ খবর)
পুলিশের ভেস্ট ও মাথায় হেলমেট পরা এক ব্যক্তি আরেক জনের সহায়তায় ভ্যানে একজন যুবকের মরদেহ তুলছেন, এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, আগে থেকে আরো কয়েকজনের মরদেহ ভ্যানের ওপরে ছিল। তার ওপরে আরও মরদেহ স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। এক মিনিট ২৮ সেকেন্ডের এ ভিডিওটি গত ৫ অগাস্ট সাভারের আশুলিয়ায় ধারন করা।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, যেসব মৃতদেহ স্তূপ করে রাখা হয়েছিল, তাদের পরিচয় সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে? ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানের ওপর ছয়-সাতজনের মরদেহ স্তুপ করে নীল চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। দেহগুলোর ওপর আরেকজনের সহায়তায় আরেকটি মরদেহ তুলছিলেন পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরিহিত একজন। প্রথমবারের দেহটি তোলা না গেলে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তা তোলা হয়।
নীল চাদর সরে যাওয়ার পর দেখা যায় নীল গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তির মাথা ভ্যানের বাইরে, তার মুখ রক্তমাখা। আরেক জনের হলুদ– সবুজ জামার হাতার অংশ দেখা যাচ্ছে। দু’জনের হাত ভ্যানের বাইরে। পরে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় মরদেহগুলো। রক্ত চুঁইয়ে নিচের রাস্তায় পড়ে রয়েছে বলে দেখা যায়। আশেপাশে আরো কয়েক জনকে হাঁটতে দেখা যায়। একজনের হাতে রাইফেল, একজনের হাতে হেলমেট, পরনে পুলিশের ভেস্ট।
ভ্যানটির বামে এ সময় পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরা বেশ কয়েক জনকে দেখা যায় যাদের হাতে রাইফেল ছিল। পেছনে বালুর বস্তা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। দেয়ালে একটি পোস্টার দেখা যায়। ভিডিওর ঘটনা ৫ অগাস্ট আশুলিয়া থানার সামনের রাস্তার। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের গলিতে থানা ভবনের সামনের ভিডিও এটি। এলাকাটি পশ্চিম পাড়া হিসেবে পরিচিত। কাছেই আশুলিয়া প্রেস ক্লাব।
‘হলুদ জার্সি পরা হাত আমার স্বামীর’
ভ্যানে থাকা যে হাতটিতে হলুদ গেঞ্জির অংশ দেখা যাচ্ছে, সেটি আবুল হোসেনের বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী লাকী আক্তার। তিনি পশ্চিমপাড়ায় থাকেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট দুপুরে উনি লুঙ্গি আর হলুদ জার্সি পরে ঘর থেকে বের হন। পরশু দিন রাতে ভিডিওটা ফেসবুকে দেখি। এতো বছর সংসার করি, আমি জার্সি দেইখা বুঝছি উনি, লুঙ্গিও দেখা গেছে।’
‘এতো বছরের সংসারে একটা মানুষের হাত দেইখা বুঝমু না? উনার সেন্ডেলে ময়লা ছিল, ভিডিওতে এটাও হাল্কা দেখা গেছে। ভিডিও দেইখা আমার শাশুড়িও কুমিল্লা থেকে চইলা আসছে’, যোগ করেন তিনি। ওইদিন বের হওয়ার পর আর দিনমজুর স্বামীর খোঁজ পাননি বলে জানান তিনি। নিখোঁজের ঘটনায় থানায় জিডি করেছেন লাকী আক্তার। এতেও স্বামীর পরনে জার্সি, লুঙ্গি ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সেন্ডেলের কথাও লিখেছেন।
কি ঘটেছিল সেদিন?
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ৫ আগস্টের দিন আন্দোলনকারীরা থানার সামনে অবস্থান নেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়ে। সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকা স্থানীয় একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটা আশুলিয়ার থানার একদম পাশেই। পুলিশ যখন গুলি করে তখন, বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এখানে সেখানে লাশগুলো পড়ে থাকে। এ অংশটুকু আমার নিজে চোখে দেখা।’
তিনি জানান, এক পর্যায়ে আশেপাশে পড়ে থাকা ছয়জনের মরদেহ পুলিশ একটা ভ্যানের মধ্যে ওঠায়, যেটার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। থানার সামনে দোতলা ভবনের জানালা দিয়ে একজন এ ভিডিও ধারণ করেন। তবে এই মরদেহগুলো কিভাবে পুলিশের গাড়িতে গেলো সেটা জানা যায়নি বলে জানান এ সাংবাদিক। অনেকেই ধারণা করছে, পুলিশই অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে গাড়িতে মরদেহগুলো রেখেছিল।
তিনি বলেন, ‘যখন আন্দোলনকারীরা থানায় হামলা চালায়, থানার সামনে আশেপাশে যত গাড়ি ছিল সবগুলোতেই আগুন ধরায়ে দিয়েছিল। তেমনই একটা পুলিশের গাড়িতে ছিল লাশগুলো। ওইগুলাও কিন্তু আগুনে পুড়ে যায়, একেবারেই ছয়টাই।’
চারজনের পরিচয় নিশ্চিত
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, চারজনের কাছে পরিচয়পত্র থাকায় স্বজনরা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। পরে মরদেহগুলো তাদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দু’জনের পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় তাদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। নিহতদের একজন গাজীপুরের একটি কলেজের শিক্ষার্থী তানজিল মাহমুদ সুজয়। তার পকেটে থাকা মানিব্যাগে পরিচয়পত্র দেখে স্বজনরা তাকে চিহ্নিত করেছে।
নিহত সুজয়ের ভাই মো. আল আমিন সরকার বলেন, ‘শনাক্তকরণের জন্য পোড়া লাশগুলো থেকে একটা একটা করে খোলা হয়েছিল। অনেকের আত্মীয় স্বজন ছিল। সর্বশেষ লাশটা সুজয়ের ছিল। সাথে ওর মানিব্যাগ, আইডি কার্ড ছিল। ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় লাশ হস্তান্তর করা হয়।’
এদিকে আগুন দেয়ার বিষয়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারী দুই পক্ষই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। তবে পুলিশই পিকআপ গাড়িতে আগুন দিয়েছে এ রকম কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ। কিছু কিছু ছবি যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কোন জায়গার তা বোঝা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। অনেকেই এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানানোয় প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেলে ‘একটু সাইলেন্টলি সেটা নিয়ে কাজটা আগাতে হবে’, নতুবা সবাই ‘হাইড’হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
ভিডিওর পুলিশ সদস্য কারা?
পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরিহিত যে ব্যক্তি বা যারা মরদেহ তুলছিলেন ভ্যানে এবং আশেপাশে যারা ছিলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিন জনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ। তিনি বলেন, ‘আমরা তিনজনকে ইতোমধ্যেই আইডেন্টিফাই করেছি। অলরেডি একটা ইনকোয়ারি কমিটি করেছি। তারা অলরেডি ইনকোয়ারি করছে। একটা কমপ্লিট রিপোর্ট আসবে।’
এ ঘটনাকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হিসেবে অভিহিত করে মুঈদ জানান, এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবীদের যে রুলস রয়েছে, সেটার আওতায়ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনই নামগুলো প্রকাশ করা যাবে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, তিন জনই থানার এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন। এই মুহূর্তে নামটা আমরা ডিসক্লোজ করছি না। আরো তদন্তের স্বার্থে। এগুলো সব আইডেন্টিফাইড। ভিজিবল, আর ভিডিও আছে যেহেতু। একইসাথে সাংবাদিকদের দেওয়া তথ্যের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।
পুলিশের এসব সদস্যকে আইনের আওতায় আনার জন্য খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাই পরিচয় প্রকাশ পেলে তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে জানিয়ে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব এটাকে আইডেন্টিফাই করে এগুলার ব্যাপারে আইনগত প্রক্রিয়া আমরা শেষ করব।’ গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, এদের মধ্যে ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন।
আরো পড়ুন: সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিসহ ১২ পুলিশের নামে চাঁদাবাজির মামলা
ভ্যানে কতগুলো মরদেহ ছিল?
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ভ্যানে থাকা মরদেহের সংখ্যা একেক ধরনের বলা হয়েছে। তবে ঢাকার পুলিশ সুপার মুঈদ ছয়টি মরদেহের কথা জানান। তিনি জানান, ভ্যানে থাকা ব্যক্তিদের একজনের হাত দেখে এক নারী নিজের স্বামী হিসেবে দাবি করেছেন। তাকে ডাকা হয়েছে। এছাড়া থানায় একটি নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে। একটি পত্রিকায় চারজনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আন্দোলনে নিখোঁজের সংখ্যা কত?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত কত মানুষ নিখোঁজ সে ধরনের কোন তালিকা হয়নি। আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ থানা পুড়িয়ে দেয়ার পর নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরে আসাটাই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন পুলিশ সুপার মুঈদ। তিনি বলেন, ‘থানাগুলোর যে সিচুয়েশন, আমাদেরতো ফাংশনাল করা এখন চ্যালেঞ্জ। অফিসার, সদস্য সবাইকে বুস্ট আপ করতেছি যেন তারা ফাংশনাল হয়, রেগুলার ওয়ার্কটা করে।’ সব কাজই হবে, সেভাবেই এগোনো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনের ঘটনায় আহত, নিহতদের তালিকা হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ কতজন রয়েছেন, সে বিষয়ে কোন তালিকা হয়নি। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ আন্দোলনে আহত, নিহতদের তালিকা করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ -কমিটি এ তালিকা তৈরিতে সহায়তা করছে।
এ কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘আহত ও নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত এগার হাজারের বেশি। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। সরকারিভাবে এ তালিকাটি করা হচ্ছে। সারা দেশের তথ্য পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে’। নিখোঁজের বিষয়ে তালিকা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে নিখোঁজ পরিবার যারা যোগাযোগ করেছেন এ রকম সংখ্যা কম বলে জানান তিনি।
অজ্ঞাতনামাদের বিষয়ে ডিএনএ টেস্ট
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার থেকে ঢাকার রায়ের বাজারে কবরস্থানে দুই মাসে ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাকে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটে ধর্মীয় রীতি অনুসারে দাহ করা হয়। এছাড়া পুলিশের পিকআপ ভ্যানের দুইটি মরদেহ এখনো শনাক্ত হয়নি। এ বিষয়ে ডিএনএ টেস্টের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, নিখোঁজ যারা আছেন তাদের বিষয়ে এখন ‘সিস্টেমেটিকেলি ওয়েতে’ আগাতে পারছি না। আহত, নিহতদের পরিবারের যারা আসছেন, তাদের নিয়ে কাজ করছি। নিখোঁজের বিষয়টা প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে।