বৃহস্প্রতি নিয়ে গবেষণায় কেন ধাঁধার মুখোমুখি জ্যোতির্বিদেরা? (Latest Update)
বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একটা ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছিলেন সে যুগের জ্যোতির্বিদেরা। বিশেষ করে, আইও উপগ্রহটি নিয়ে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ। পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণনে চাঁদ একটা নিয়ম মেনে চলে। ২৭.৩ দিনে এক পাক ঘুরে আসে চাঁদ। বৃহস্পতির চাঁদগুলোর ঘূর্ণনেও একটা নিয়ম পাওয়া যাবে বলে আশা করেছিলেন জ্যোতির্বিদেরা।
কিন্তু সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন তাঁরা। দেখা গেল, বৃহস্পতির চারপাশে আইওর ঘূর্ণনে একটা নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার আছে। মাঝেমধ্যে বৃহস্পতির পেছন থেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই দৃষ্টিসীমায় এসে হাজির হয় আইও। আবার অন্য কিছু সময় হাজির হয় কয়েক মিনিট পর। কোনো গ্রহের উপগ্রহের এরকম আচরণ করা উচিত নয় বলে মনে করতেন জ্যোতির্বিদেরা। আইওর এহেন উদাসীন আচরণে ধাঁধায় পড়ে গেলেন তাঁরা।
এই রহস্য ভেদ করতে ক্যাসিনির তালিকাবদ্ধ করা আইওর অবস্থান এবং দৃষ্টিসীমায় তার হাজির হওয়ার সময় নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা করেন রোমার। তিনি দেখতে পান, বছরের অর্ধেক সময় আইওসহ বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ লাগে ক্রমেই নির্ধারিত সময়ের পরে পরে।
আর বছরের বাকি অর্ধেক সময় গ্রহণ লাগতে থাকে ক্রমেই নির্ধারিত সময়ের আগে আগে। সারা বছর ধরে গ্রহণগুলো গড়ে সঠিক সময়ে লাগে, কিন্তু গ্রহণ লাগার এমন কিছু সময় ছিল, যেগুলো গড় সময় থেকে প্রায় ৮ মিনিটের মতো এগিয়ে ছিল এবং কিছু সময় ছিল গড় সময় থেকে প্রায় ৮ মিনিটি পিছিয়ে। এর কারণ কী? এরকম ঘটে কেন? ভেবে কুল পান না রোমার।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এভাবে এক বছরে একটা বৃত্ত তৈরি করে (তখনও সূর্যের চারপাশের গ্রহদের উপবৃত্তাকার গতিপথ সম্পর্কে জ্যোতির্বিদেরা জানেন না)। পৃথিবীর তুলনায় বৃহস্পতি সূর্য থেকে আরও দূরে অবস্থিত। তাই বছরে বৃহস্পতি সূর্যের চারপাশে ঘুরতে গিয়ে যে বৃত্ত তৈরি করে, তা আরও বড়।
সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে বৃহস্পতির সময় লাগে পৃথিবীর হিসেবে ১২ বছর। কাজেই বৃহস্পতি সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে যে সময় নেয়, সেই সময়ে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরে আসে ১২ বার। তার মানে, বছরের অর্ধেক সময় বৃহস্পতি ও পৃথিবী সূর্যের একই পাশে থাকে। আর বাকি অর্ধেক সময় বৃহস্পতি সূর্যের যে পাশে থাকে, পৃথিবী থাকে তার উল্টো পাশে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোমার সিদ্ধান্তে এলেন, এই রহস্য ভেদ করা সম্ভব, যদি ধরে নেওয়া হয় আলোর গতি সসীম। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আলোর পৌঁছাতে একটা নির্দিষ্ট সময় লাগে। ঠিক শব্দের মতো। রোমার যুক্তি দেখান, আইও বা বৃহস্পতির অন্য উপগ্রহের গ্রহণের আপাত অনিয়মিত হওয়ার কারণ আসলে একটি দৃষ্টিবিভ্রম। কারণ আইও থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে থাকা পৃথিবীতে পৌঁছাতে আলোর ভিন্ন ভিন্ন সময় লাগে। আলো সসীম বলেই সেটা ঘটে।
বৃহস্পতির উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতেও প্রায় একই ব্যাপার ঘটে। পৃথিবী ও বৃহস্পতি যখন সূর্যের একই পাশে থাকে, তখন স্বভাবতই গ্রহ দুটি যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকে। তখন বৃহস্পতি এবং তার উপগ্রহগুলো থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে একটা নির্দিস্ট দূরত্ব পাড়ি দেয়। অর্ধ বছর বা ছয় মাস পর, পৃথিবী চলে যায় বৃহস্পতির উল্টো পাশে। তখন সূর্যের এক পাশে বৃহস্পতি এবং আরেক পাশে পৃথিবী।
কাজেই এখন বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহগুলো থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আগের ছয় মাসের চেয়ে বেশি। এখন বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহগুলোর আলোকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে আগের দূরত্ব তো পাড়ি দিতে হবেই, সেই সঙ্গে বাড়তি কিছু দূরত্বও পাড়ি দিতে হবে। আর এই বাড়তি দূরত্বটা হবে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের প্রস্থ। মানে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব।
পৃথিবীর পুরো প্রস্থ পাড়ি দিতে আলোর একটি নির্দিষ্ট সময় লাগবে। পৃথিবীর জ্যোতির্বিদদের তাই বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ দেখতে অপেক্ষা করতে হয় বাড়তি কিছু সময়। এ কারণেই সেখানে গ্রহণ লাগে গড় সময়ের চেয়ে কয়েক মিনিট দেরিতে। আবার পৃথিবী ও বৃহস্পতি যখন সূর্যের একই পাশে থাকে, তখন আলো তুলনামূলক কম পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছে। তাই এ সময় গ্রহণগুলো ঘটে গড় সময়ের কয়েক মিনিট আগে। সেটাই আসলে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন রোমার।
অবশ্য রোমারের যুগে পৃথিবীর কক্ষপথের প্রশস্ততা বা ব্যাস (সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব) সঠিকভাবে মাপা সম্ভব হয়নি। সে যুগে সবচেয়ে সেরা মাপটিই ব্যবহার করেন রোমার। এভাবে আইও এবং পৃথিবী ও বৃহস্পতির আপেক্ষিক দূরত্ব নিয়ে তিন বছর পর্যবেক্ষণ করেন। সব শেষে তিনি হিসেব কষে দেখেন, এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর সময় লাগছে প্রায় ২২ মিনিট (এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে)।
এভাবে আলো সেকেন্ডে কত পথ পাড়ি দেয়, তা হিসেব করা সম্ভব। এতে সেকেন্ডে আলোর গতি পাওয়া গেল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে, আলোর গতি অসীম না হলেও পৃথিবীর যেকোনো গতির চেয়ে অনেক বেশি। সে কারণেই চোখের পলকে আলো পাড়ি দেয় কল্পনাতীত দূরত্ব।