আন্দোলন বন্যা মুদ্রাস্ফীতিতে অর্ধেকে নেমেছে বই কেনাবেচা (গুরুত্বপূর্ণ খবর)
সারা দেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিন-চার মাসে বইয়ের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং সারা দেশে ভয়াবহ বন্যাসহ নানা কারণে বইয়ের বিক্রি কমাতে ভূমিকা রেখেছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
বইয়ের বাজারে এমন ধসের পরও আশা দেখছেন প্রকাশকরা। তারা বলছেন, গত জুলাই থেকে কোটা আন্দোলনে দেশের পরিস্থিতি বদলে যাওয়া, নতুন সরকার গঠিত হওয়া এবং সারা দেশে ভয়াবহ বন্যা– সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন আরও করুণ। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে খুব দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে আদর্শ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বই বিক্রির অবস্থা এমনিতেই খারাপ পর্যায়ে আছে। এই অস্থিতিশীল পরিবেশে সেটা আরও বেড়েছে। এমনিতেই বইমেলা ছাড়া আমরা বই প্রকাশ করতে পারি না। লেখকরাও আমাদের এখন আর পাণ্ডুলিপি দেন না। তারা এখন লেখালেখি করেন মেলাকে কেন্দ্র করে।
সারা দেশে সমিতির আওতায় প্রায় ২৬ হাজার সদস্য এবং দেড় লাখেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। পুরো খাতের সঙ্গে জড়িত লোকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। সারা দেশে লাইব্রেরি আছে ২৬ হাজারের মতো। এ ছাড়া প্রেস, বাইন্ডিং আছে। সব মিলিয়ে এ খাতে ধস নামায় সংশ্লিষ্ট সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বর্তমান বাজারে বই বিক্রিতে ধস নেমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সেলস টিম লাইব্রেরিতে গেলে বলে দিচ্ছে যে, বাজারে বই বিক্রির অবস্থা ভালো নয়। তাদেরও ক্রেতাসংকট চলছে। তাই আমার কর্মীরা কোনো অর্ডার আনতে পারছেন না। গত জুলাই থেকে এ ধস শুরু হয়। আগের তুলনায় আমার ৪০ শতাংশ বিক্রি কমেছে।
অনলাইনে বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের অনলাইনে বই বিক্রি হয়। কিন্তু এ মাধ্যমেও এখন আগের মতো বিক্রি হচ্ছে না। অনলাইনে আগে প্রতি মাসে যে পরিমাণ সেল থাকত, এখন তা অনেক কমে এসেছে। গত জুলাই থেকে অনলাইন-অফলাইন দুটোতেই প্রভাব পড়েছে। যেসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বই বিক্রি করছে, তার মধ্যে বেশির ভাগই রকমারি ডট কমের দখলে। কিন্তু শুধু রকমারি তো আর সব চাহিদা পূরণ করতে পারবে না সে জন্য আমরা প্রকাশকরা নিজেরাও চেষ্টা করছি অনলাইনে বিক্রি করার জন্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি মধ্যে মধ্যম আয়ের মানুষ তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে বই কেনা এখন কমিয়ে দিয়েছেন তারা। যারা বইপ্রেমী ছিল, মূল্যস্ফীতির কারণে তারাও বই কেনা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে সব ধরনের পাঠক হারিয়েছে। দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে।
তাদের ভাষ্য, আগে মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, বাসা থেকে বের হতে পারেনি। এখন তারা দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৫ আগস্টের পর এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে দেশে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে। বই বিক্রির জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার, সেটা এখনো ফেরত আসেনি। তবে ভালো দিন আসবে বলে আশা তাদের।
বই বিক্রির বাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালক ও কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি আবদুল হান্নান ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দেশে এখন অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে স্কুল-কলেজও বন্ধ। সিলেবাস পরিবর্তন হওয়ায় পরীক্ষাপদ্ধতি নেই বললেই চলে। ছাত্র-ছাত্রীরা এখন মোবাইলমুখী পড়াশোনা করে। পরীক্ষাপদ্ধতি না থাকলে পড়াশোনার মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে। গত তিন-চার মাসে বই বিক্রি কমেছে প্রায় ৫০ ভাগ। সব মিলিয়ে খুবই হতাশাজনক পরিস্থিতি চলছে এ খাতে।
দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এ খাতে কতটা পরিবর্তন আসবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। আগামী বছর শুধু কলেজগুলো চলবে। এ ছাড়া দেশের পরিস্থিতির কারণে উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি বই এখনো বের হয়নি। সরকারও কিছু জানাচ্ছে না। তবে আশা করা যায়, দুই-তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে।
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ আপাতত স্থগিত রয়েছে। পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হবে, এমন খবরের ভিত্তিতে আপাতত ছাপা হচ্ছে না পাঠ্যপুস্তক।
এ বিষয়ে আবদুল হান্নান বলেন, নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ আপাতত স্থগিত আছে। এর আগে বাংলা ও ইংরেজি বই ছাপানোর দরপত্র হয়। গত ৮ আগস্ট আমাদের হাতে বই দেওয়ার কথা ছিল। এখন সেটা স্থগিত হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী বছর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, এখন বলা হচ্ছে আগের কারিকুলামে ছাপা হবে। আসলে সরকারের সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আপাতত ছাপা হচ্ছে না পাঠ্যপুস্তক। তারা কারিকুলাম বাতিল করবে নাকি পুরোনো কারিকুলামেও ফেরত যাবে, কিছুই পরিষ্কার নয়। সিদ্ধান্ত জানালে ছাপার কাজ শুরু হবে। তবে কারিকুলাম পরিবর্তন হলে নতুন বইয়ের মাধ্যমে বেচাকেনা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
আরো পড়ুন: ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন বন্ধ ও চতুর্থ ধাপে ভর্তির সময় ঘোষণা
এ পরিস্থিতিতে প্রকাশনা খাতে যুক্ত সদস্য ও কর্মীরা কীভাবে জীবনযাপন করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা দেশে সমিতির আওতায় প্রায় ২৬ হাজার সদস্য এবং দেড় লাখেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। পুরো খাতের সঙ্গে জড়িত লোকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। সারা দেশে লাইব্রেরি আছে ২৬ হাজারের মতো। এ ছাড়া প্রেস, বাইন্ডিং আছে। সব মিলিয়ে এ খাতে ধস নামায় সংশ্লিষ্ট সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
পরিচালক আবদুল হান্নান বলেন, প্রকাশনা খাতে বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। মহামারি করোনাভাইরাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ খাতে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে।