মহানবী (সাঃ) এর জীবনী

বানুল মুছত্বালিক্ব অথবা মুরাইসী‘ যুদ্ধ

বানুল মুছত্বালিক্ব অথবা মুরাইসী‘ যুদ্ধ
★★★ সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে। কারণ ছিল এই যে, এ মর্মে মদীনায় খবর পৌঁছে যে, বানুল মুছত্বালিক্ব গোত্রের সর্দার হারেছ বিন আবু যাররাব রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নিজ গোত্র এবং সমমনা অন্যান্য আরব বেদুঈনদের সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন।
বুরাইদা আসলামীকে পাঠিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) উক্ত খবরের সত্যতা যাচাই করলেন। তিনি সরাসরি গোত্র নেতা হারেছ-এর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে রাসূলকে উক্ত বিষয়ে অবহিত করেন।
অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ৩রা শা‘বান তারিখে মদীনা হতে সসৈন্যে রওয়ানা হন। সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায়নি। তবে ওহোদ যুদ্ধ থেকে পিছু হটার পর এ যুদ্ধেই প্রথম মুনাফিকদের একটি দল রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধে গমন করে। ইতিপূর্বে তারা কোন যুদ্ধে গমন করেনি। এ সময় মদীনার দায়িত্ব যায়েদ বিন হারেছাহ অথবা আবু যার গেফারী অথবা নামীলাহ বিন আব্দুল্লাহ লায়ছীর উপরে অর্পণ করা হয়। যাত্রা পথে গোত্র নেতা হারেছ প্রেরিত একজন গুপ্তচর আটক হয় ও নিহত হয়।
এ খবর জানতে পেরে হারেছ বাহিনীতে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং তার সঙ্গে থাকা আরব বেদুঈনরা সব পালিয়ে যায়। ফলে বানুল মুছত্বালিকের সাথে ক্বাদীদ -এর সন্নিকটে সাগর তীরবর্তী মুরাইসী‘ নামক ঝর্ণার পার্শ্বে মুকাবিলা হয় এবং তাতে সহজ বিজয় অর্জিত হয়। মুশরিক পক্ষে ১০ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হয় এবং মুসলিম পক্ষে একজন শহীদ হন। জনৈক আনছার ছাহাবী তাকে শত্রুসৈন্য ভেবে ভুলক্রমে হত্যা করেন।
উক্ত যুদ্ধ সম্পর্কে জীবনীকারগণের বক্তব্য উক্ত রূপ। তবে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন যে, উক্ত বর্ণনা ভ্রমাত্মক মাত্র। কেননা প্রকৃত প্রস্তাবে বানুল মুছত্বালিকের সাথে মুসলিম বাহিনীর কোনরূপ যুদ্ধই হয়নি। বরং মুসলিম বাহিনী তাদের উপরে আকস্মিক হামলা চালালে তারা সব পালিয়ে যায় ও তাদের নারী-শিশুসহ বহু লোক বন্দী হয়। [1]
বন্দীদের মধ্যে গোত্রনেতা হারেছ বিন যাররাবের কন্যা জুওয়াইরিয়া ছিলেন। যিনি ছাবেত বিন ক্বায়েস-এর ভাগে পড়েন। ছাবেত তাকে ‘মুকাতিব’ হিসাবে চুক্তিবদ্ধ করেন। মুকাতিব ঐ দাস বা দাসীকে বলা হত, যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ স্বীয় মনিবকে দেয়ার শর্তে চুক্তি সম্পাদন করে এবং উক্ত অর্থ পরিশোধ করার পর সে স্বাধীন হয়ে যায়।
নবী করীম (সাঃ) তার পক্ষ থেকে চুক্তি পরিমাণ অর্থ প্রদান পূর্বক তাকে মুক্ত করেন এবং তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। এই বিবাহের ফলশ্রুতিতে মুসলমানগণ বনু মুছত্বালিক গোত্রের বন্দী একশত পরিবারের সবাইকে মুক্ত করে দেন এবং তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। এর ফলে তারা সবাই ‘রাসূলের শ্বশুর গোত্রের লোক’ বলে পরিচিতি পায়। [2]
ইফকের ঘটনা:
রাসূল (সাঃ)-এর নিয়ম ছিল কোন যুদ্ধে যাওয়ার আগে স্ত্রীদের নামে লটারি করতেন। লটারিতে যার নাম উঠতো, তাকে সঙ্গে নিতেন। সে হিসাবে বানুল মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর সফরসঙ্গিনী হন। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথে বিশ্রামস্থলে তার গলার স্বর্ণহারটি হারিয়ে যায়। যা তিনি তাঁর বোনের কাছ থেকে ধার হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন।
প্রকৃতির ডাকে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন, সেখানেই হারটি পড়ে গেছে মনে করে তিনি পুনরায় সেখানে গমন করেন। ইতিমধ্যে কাফেলার যাত্রা শুরু হলে তাঁর হাওদা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তি ভেবেছিলেন, তিনি হাওদার মধ্যেই আছেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন হালকা-পাতলা গড়নের। ফলে ঐ ব্যক্তির মনে কোনরূপ সন্দেহের উদ্রেক হয়নি যে, তিনি হাওদার মধ্যে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) হার পেয়ে যান এবং দ্রুত নিজের স্থানে ফিরে এসে দেখেন যে, সব ফাঁকা । তখন তিনি নিজের স্থানে শুয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, নিশ্চয়ই তাঁর খোঁজে এখুনি লোকেরা এসে যাবে। অতঃপর তিনি ঘুমিয়ে গেলেন।
ছাফওয়ান বিন মু‘আত্ত্বাল সবশেষে জেগে উঠে ত্রস্তপদে যেতে গিয়ে হঠাৎ মা আয়েশার প্রতি নযর পড়ায় জোরে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পাঠ করেন ও নিজের উটটি এনে তাঁর পাশে বসিয়ে দেন। আয়েশা (রাঃ) তার ‘ইন্নালিল্লাহ’ শব্দে জেগে ওঠেন ও কোন কথা না বলে উটের পিঠে হাওদায় গিয়ে বসেন। অতঃপর ছাফওয়ান উটের লাগাম ধরে হাঁটতে থাকেন।
পর্দার হুকুম নাযিলের আগে তিনি আয়েশাকে দেখেছিলেন বলেই তাঁকে সহজে চিনতে পেরেছিলেন। দুজনের মধ্যে কোন কথাই হয়নি এবং মা আয়েশাও কোন কথা শুনেননি ‘ইন্না লিল্লাহ’ শব্দ ছাড়া। দুপুরের খরতাপে যখন রাসূল (সাঃ)-এর সেনাদল বিশ্রাম করছিল, তখনই গিয়ে মা আয়েশা (রাঃ) তাদের সঙ্গে মিলিত হলেন।
সৎ ও সরল প্রকৃতির লোকেরা বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু কুটবুদ্ধির লোকেরা এবং বিশেষ করে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এটাকে কুৎসা রটনার একটি বিশেষ হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করল। মদীনায় ফিরে এসে তারা এই সামান্য ঘটনাকে নানা রঙ চড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জোটবদ্ধভাবে প্রচার করতে লাগল। তাতে দুর্বলচেতা বহু লোক তাদের ধোঁকার জালে আবদ্ধ হল। এই অপবাদ ও অপপ্রচারের জবাব অহি-র মাধ্যমে পাবার আশায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সম্পূর্ণ চুপ রইলেন।
কিন্তু দীর্ঘ দিন অপেক্ষার পরেও কোনরূপ অহী নাযিল না হওয়ায় তিনি একদিন কয়েকজন ছাহাবীকে ডেকে পরামর্শ চাইলেন। তাতে হযরত আলী (রাঃ) ইশারা-ইঙ্গিতে তাকে পরামর্শ দিলেন আয়েশাকে তালাক দেবার জন্য। অপরপক্ষে উসামা ও অন্যান্যগণ তাঁকে রাখার এবং শত্রুদের কথায় কর্ণপাত না করার পরামর্শ দেন। এরপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অব্যাহত কুৎসা রটনার মনোকষ্ট হতে রেহাই পাবার জন্য একদিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করলেন।
তখন আউস গোত্রের পক্ষে উসায়েদ বিন হুযায়ের (রাঃ) তাকে হত্যা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। একথা শুনে খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহর মধ্যে গোত্রীয় উত্তেজনা জেগে ওঠে এবং তিনি এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল খাযরাজ গোত্রের লোক। এর ফলে মসজিদে উপস্থিত উভয় গোত্রের লোকদের মধ্যে উত্তেজিত বাক্য বিনিময় শুরু হয়ে যায়। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদেরকে থামিয়ে দেন।
এদিকে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর মা আয়েশা (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একটানা মাসব্যাপী পীড়িত থাকেন। বাইরের এতসব অপবাদ ও কুৎসা রটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতে পারেননি। তবে অসুস্থ অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-এর কাছ থেকে যে আদর-যত্ন ও সেবা-শুশ্রূষা পাওয়ার কথা ছিল, তা না পাওয়ায় তিনি মনে মনে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর কিছুটা সুস্থতা লাভ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য একরাতে তিনি উম্মে মিসতাহর সাথে নিকটবর্তী এক মাঠে গমন করেন।
এ সময় উম্মে মিসতাহ নিজের চাদরে পা জড়িয়ে পড়ে যান এবং নিজের ছেলেকে বদ দো‘আ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এটাকে অপসন্দ করলে উম্মে মিসতাহ তাকে সব খবর বলে দেন (কেননা তার ছেলে মিসতাহ উক্ত কুৎসা রটনায় অগ্রণী ভূমিকায় ছিল)। হযরত আয়েশা ফিরে এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি চাইলেন। অতঃপর অনুমতি পেয়ে তিনি পিতৃগৃহে চলে যান। সেখানে সব কথা জানতে পেরে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুই রাত ও একদিন নির্ঘুম কাটান ও অবিরতধারে কাঁদতে থাকেন।
এমতাবস্থায় রাসূল (সাঃ) তার কাছে এসে তাশাহহুদ পাঠের পর বললেন, ‘হে আয়েশা! তোমার সম্পর্কে কিছু বাজে কথা আমার কানে এসেছে। যদি তুমি নির্দোষ হও, তবে সত্বর আল্লাহ তোমাকে দোষমুক্ত করবেন। আর যদি তুমি কোন পাপকর্মে জড়িয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তওবা কর। কেননা বান্দা যখন দোষ স্বীকার করে ও আল্লাহর নিকটে তওবা করে, তখন আল্লাহ তার তওবা কবুল করে থাকেন’।
রাসূল (সাঃ)-এর এ ভাষণ শুনে আয়েশার অশ্রু শুকিয়ে গেল। তিনি তার পিতা-মাতাকে এর জবাব দিতে বললেন। কিন্তু তাঁরা এর জবাব খুঁজে পেলেন না। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! যে কথা আপনারা শুনেছেন ও যা আপনাদের অন্তরকে প্রভাবিত করেছে এবং যাকে আপনারা সত্য বলে মেনে নিয়েছেন- এক্ষণে আমি যদি বলি যে, ‘আমি নির্দোষ এবং আল্লাহ জানেন যে, আমি নির্দোষ’- তবুও আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। পক্ষান্তরে আমি যদি বিষয়টি স্বীকার করে নিই, অথচ আল্লাহ জানেন যে, আমি এ ব্যাপারে নির্দোষ- তাহলে আপনারা সেটাকে বিশ্বাস করে নিবেন।
এমতাবস্থায় আমার ও আপনার মধ্যে ঐ উদাহরণটাই প্রযোজ্য হবে যা হযরত ইউসুফের পিতা (হযরত ইয়াকূব) বলেছিলেন, ‘অতএব ধৈর্য ধারণই উত্তম এবং আল্লাহর নিকটেই সাহায্য কাম্য, যেসব বিষয়ে তোমরা বলছ’ (ইউসুফ ১২/১৮)। একথাগুলো বলেই হযরত আয়েশা (রাঃ) অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং ঐ সময়েই রাসূল (সাঃ)-এর উপরে অহী নাযিল শুরু হয়ে গেল )।
অহি-র অবতরণ শেষ হলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হাসিমুখে আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে অপবাদ থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন’। এতে খুশী হয়ে তার মা বললেন, আয়েশা ওঠো, রাসূলের কাছে যাও’। কিন্তু আয়েশা অভিমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘না আমি তাঁর কাছে যাব না। আমি আল্লাহ ছাড়া কারু প্রশংসা করব না’। এটা ছিল নিঃসন্দেহে তার সতীত্বের তেজ এবং তার প্রতি রাসূল (সাঃ)-এর প্রগাঢ় ভালোবাসার উপরে গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ। উল্লেখ্য যে, এই সময় সূরা নূরের ১১ হতে ২০ পর্যন্ত ১০টি আয়াত নাযিল হয়।
এরপর মিথ্যা অপবাদের দায়ে মিসতাহ বিন আছাছাহ , কবি হাসসান বিন ছাবেত ও হামনা বিনতে জাহশের উপরে ৮০টি করে দোররা মারার শাস্তি কার্যকর করা হয়। কেননা ইসলামী শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী কেউ যদি কাউকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, অতঃপর তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তাহলে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি স্বরূপ তাকে আশি দোররা বা বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রদান করা হয়।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ইফকের ঘটনার মূল নায়ক মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে দন্ড হতে মুক্ত রাখা হয়। এর কারণ এটা হতে পারে যে, আল্লাহ পাক তাকে পরকালে কঠিন শাস্তি দানের ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন। অতএব এখন শাস্তি দিলে পরকালের শাস্তি হালকা হয়ে যেতে পারে। অথবা অন্য কোন মাছলাহাতের কারণে তাকে শাস্তি প্রদান করা হয়নি’। [6]
ফুটনোট:
[1] বুখারী হা/২৫৪১; ফৎহুলবারী ৭/৩৪১-৪৩১। [2] আবুদাঊদ হা/৩৯৩১, সনদ হাসান।
[3] বুখারী হা/৬২০৭।
[4] আল-বিদায়াহ ৪/১৫৭ পৃঃ, ইবনু ইসহাক্ব থেকে মুরসাল সুত্রে; ইবনে হিশাম ২/২৯০-৯২; তবে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে বুখারী হা/৪৯০৭; মুসলিম হা/২৫৮৪; আহমাদ হা/১৪৬৭৩।
[5] তিরমিযী হা/৩৩১৫।
[6] বুখারী হা/২৬৬১,৪১৪১; মুসলিম হা/২৭৭০, ইবনে হিশাম ২/২৯৭-৩০৭।
[7] ইবনে হিশাম ২/২৯৩।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button