মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
ক্বাযা ওমরাহ ও মায়মূনার সাথে রাসূলের বিবাহ
ক্বাযা ওমরাহ ও মায়মূনার সাথে রাসূলের বিবাহ
(৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ)
হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওমরাহ করার জন্য প্রস্তুতি নেন। গত বছরে যারা হোদায়বিয়ায় হাযির ছিলেন, তাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা ছাড়াও অন্যান্যগণ মিলে মোট দুহাযার ব্যক্তি রাসূলের সঙ্গে বের হন। মহিলা ও শিশুরা ছিল এই সংখ্যার বাইরে।[1] মুশরিকদের চুক্তি ভঙ্গের আশংকায় যুদ্ধে পারদর্শী লোকদের এবং যুদ্ধাস্ত্র সমূহ সঙ্গে নেয়া হয় (ঐ)।
আবু রুহম ‘ওয়াইফ আল-গেফারী কে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন কুরবানীর জন্য ৬০টি উট। অতঃপর যুল-হুলায়ফা পৌঁছে ওমরাহর জন্য এহরাম বাঁধলেন এবং সকলে উঁচু স্বরে ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দেন। মক্কার নিকটবর্তী ইয়াজেজ নামক স্থানে পেঁŠছে বর্ম, ঢাল, বর্শা, তীর প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র সমূহ রেখে দেওয়া হল।
আওস বিন খাওলী আনছারীর নেতৃত্বে দু’শো লোককে এগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য সেখানে রাখা হল। বাকীরা মুসাফিরের অস্ত্র ও কোষবদ্ধ তরবারিসহ মক্কায় গমন করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় উষ্ট্রী ক্বাছওয়া -এর পিঠে সওয়ার ছিলেন এবং মুসলমানগণ স্ব স্ব তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে রাসূলকে মাঝে রেখে ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে থাকেন। ‘হাজুন’ মুখী টিলার পথ ধরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কায় প্রবেশ করেন।
মুশরিকরা সব বেরিয়ে মক্কার উত্তর পার্শ্বে ‘কু‘আই ক্বা‘আন’ পাহাড়ের উপরে জমা হয়ে মুসলমানদের আগমন দেখতে থাকে এবং বলাবলি করতে থাকে যে, ইয়াছরিবের জ্বর এদের দুর্বল করে দিয়েছে’। একথা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) সবাইকে নির্দেশ দিলেন যেন ত্বাওয়াফের সময় প্রথম তিনটি চক্কর দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে, যাকে ‘রমল’ বলা হয়। [2]
তবে রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান স্বাভাবিক ভাবে অতিক্রম করবে। এ নির্দেশ তিনি এজন্যে দেন, যাতে মুশরিকেরা মুসলমানদের শক্তি-ক্ষমতা দেখতে পায়। একই উদ্দেশ্যে তিনি তাদের ইযত্বেবার নির্দেশ দেন। যার অর্থ হল ডান কাঁধ খোলা রেখে বগলের নীচ দিয়ে চাদর বাম কাঁধের উপরে রাখা। এর মাধ্যমে একজনকে সদা প্রস্তত ও স্মার্ট দেখা যায়। মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাসূলকে দেখতে থাকে। এরি মধ্যে তিনি ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে দিতে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন এবং স্বীয় লাঠি দ্বারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন।
অতঃপর ত্বাওয়াফ করেন ও মুসলমানেরাও ত্বাওয়াফ করে। ত্বাওয়াফের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) যুদ্ধছন্দে পাঁচ লাইনের কবিতা বলতে বলতে রাসূলের আগে আগে চলতে থাকেন। এতে হযরত ওমর (রাঃ) তাকে বলেন, ‘হে ইবনে রাওয়াহা! আল্লাহর রাসূলের সামনে ও আল্লাহর হারামের মধ্যে তুমি কবিতা পাঠ করছ’? তখন রাসূল (সাঃ) ওমরকে বললেন, ‘ওকে ছাড় ওমর! এটা ওদের জন্য বর্শার আঘাতের চাইতেও দ্রুত কার্যকরী’।[3]
মুসলমানদের এই দ্রুতগতির ত্বাওয়াফ ও কার্যক্রম দেখে মুশরিকদের ধারণা পাল্টে গেল এবং বলতে লাগল যে, তোমাদের ধারণা ছিল ভুল। ‘বরং ওরা তো দেখছি অমুক অমুকের চাইতে বেশী শক্তিশালী’। [4]
ত্বাওয়াফ শেষে তাঁরা সাঈ করেন এবং এ সময় মারওয়ার নিকটে তাদের কুরবানীর পশুগুলি দাঁড়ানো ছিল। সাঈ শেষে রাসূল (সাঃ) সেখানে গিয়ে বললেন, ‘এটাই হল কুরবানীর স্থান এবং মক্কার সকল অলি-গলি হল কুরবানীর স্থল’। [5]
অতঃপর তিনি সেখানে উটগুলি নহর করেন এবং মাথা মুন্ডন করেন। মুসলমানেরাও তাই করেন। এভাবে হালাল হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একদল ছাহাবীকে ইয়াজেজ পাঠিয়ে দেন, যাতে তারা সেখানে গিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র পাহারায় থাকে এবং অন্যদের ওমরাহর জন্য পাঠিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন।
চতুর্থ দিন সকালে মুশরিক নেতারা এসে আলী (রাঃ)-কে বলেন যে, সন্ধি চুক্তি অনুযায়ী তিনদিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার তোমাদের নেতাকে যেতে বল। তখন রাসূল (সাঃ) মক্কা থেকে বেরিয়ে এসে ‘সারফ’ নামক স্থানে অবস্থান করেন।
মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ)-এর শিশুকন্যা আমাতুল্লাহ হে চাচা হে চাচা বলতে বলতে ছুটে আসে। হযরত আলী (রাঃ) তাকে কোলে তুলে নেন। এরপর আলী, জা‘ফর ও যায়েদ বিন হারেছাহর মধ্যে বিতর্ক হয়। কেননা সবাই তাকে নিতে চান। তখন রাসূল (সাঃ) জা‘ফরের অনুকূলে ফায়ছালা দিলেন। কেননা জা‘ফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস ছিলেন মেয়েটির আপন খালা। [6]
মায়মূনার সাথে রাসূলের বিবাহ:
অত্র ওমরাহ পালন শেষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়মূনাহ বিনতুল হারেছকে বিবাহ করেন। ইতিপূর্বে তাঁর দু’বার বিয়ে হয়েছিল এবং এ সময় তিনি বিধবা ছিলেন। তিনি হযরত খালেদ ইবনু ওয়ালীদের আপন খালা এবং রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের আপন শ্যালিকা ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের মা উম্মুল ফযল ছিলেন তার আপন বড় বোন।
বিধবা হওয়ার পরে আববাস তার বিষয়ে আল্লাহর রাসূলকে ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন। সেমতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জা‘ফর ইবনু আবী ত্বালেবকে আগেই মক্কায় পাঠিয়ে দেন। চাচা আববাসের দায়িত্বে বিবাহের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হয় এবং যথাসময়ে বিবাহ হয়ে যায়। মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আববাস-এর গোলাম আবু রাফে‘ যে গোপনে মুসলমান ছিল, তাকে দায়িত্ব দিয়ে আসেন যাতে মায়মূনাকে সওয়ারীতে বসিয়ে রাসূলের কাছে নিয়ে আসে। সেমতে তাঁকে ‘সারফে’ পৌঁছে দেওয়া হয়। যেখানে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কাফেলা সহ অবস্থান করছিলেন। [7]
ফুটনোট:
[1] ফাৎহুল বারী ৭/৫৭২ হা/৪২৫২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; ‘যুদ্ধ বিগ্রহ’ অধ্যায়-৬৪, ‘ক্বাযা ওমরাহ’অনুচ্ছেদ-৪৩। [2] বুখারী হা/৪২০৬; মুসলিম হা/১২৬৬।
[3] তিরমিযী ‘শিষ্টাচার ও অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায়, ‘কবিতা আবৃত্তি’ অনুচ্ছেদ হা/২৮৪৭; নাসাঈ হা/২৮৭৩।
[4] মুসলিম হা/১২৬৬।
[5] আবুদাঊদ হা/২৩২৪।
[6] আহমাদ হা/৭৭০; ছহীহাহ হা/১১৮২।
[7] যাদুল মা‘আদ ৩/৩২৮-২৯।