মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ
(১ম হিজরীর রামাযান হ’তে ১১ হিজরীর ছফর পর্যন্ত):
শুধুমাত্র রাসুল (সঃ) এর সরাসরি অংশগ্রহন করা বিখ্যাত যুদ্ধ সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।
১। গাযওয়া ওয়াদ্দান:
২য় হিজরীর ছফর মাসে (৬২৩ খৃঃ আগষ্ট মাস) রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি কুরায়েশ কাফেলার বিরুদ্ধে পরিচালিত ৭০ জনের মুহাজির বাহিনী। যুদ্ধ হয়নি। তবে স্থানীয় বনু যামরাহ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটাই ছিল রাসূলের জীবনে প্রথম যুদ্ধাভিযান। এই সফরে তিনি ১৫ দিন অতিবাহিত করেন। পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।
২। গাযওয়া সাফওয়ান:
২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রাসূলের নেতৃত্বে ৭০ জনের দল। প্রতিপক্ষ মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী পালিয়ে যায়। সে ছিল মদীনার উপকণ্ঠে প্রথম হামলাকারী এবং গবাদি-পশু লুটকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই লুটেরাদের ধাওয়া করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত গমন করেন। এজন্য এই অভিযানকে গাযওয়া বদরে ঊলা বা প্রথম বদর যুদ্ধ বলা হয়।
৩। গাযওয়ায়ে বদর:
২য় হিজরীর ১৭ রামাযান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ মার্চ শুক্রবার। রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের অপ্রস্ত্তত বাহিনী। কুরায়েশ পক্ষে আবু জাহলের নেতৃত্বে ১০০০ লোকের সুসজ্জিত বাহিনী। মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার সহ ১৪ জন শহীদ এবং কুরায়েশ পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। আবু জাহল সহ নিহতদের অধিকাংশ ছিল মক্কার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বদর যুদ্ধ উপলক্ষে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যাতে গনীমতের বিধান বর্ণিত হয়।
৪। গাযওয়া বনু কায়নুক্বা:
২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই প্রথম চুক্তি ভঙ্গকারী এবং তাদের বাজারে এক দুধ বিক্রেতা মুসলিম মহিলাকে বিবস্ত্রকারী এই নরাধম ইহুদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খায়বার গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন।
এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহুদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে। [1]
৫। গাযওয়া ওহোদ:
৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল। কুরায়েশ বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একদল মহিলা ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উৎসাহিত করে। এই যুদ্ধে রাসূলের নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। যাদের মধ্যে হামযা একাই ৩১ জনকে হত্যা করেন ও নিজে শহীদ হন। মুসলমানদের ক্ষতি হলেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়।
৬। সারিইয়া রাজী‘:
৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে আযাল ও ক্বারাহ (عضل وقارة) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূলের দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদের অধিক তা‘লীমের প্রয়োজন। সেকারণ কয়েকজন উঁচু মর্তবার ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে আছেম বিন ছাবিতের নেতৃত্বে ১০ জন বুযর্গ ছাহাবীকে প্রেরণ করেন।
তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী ‘রাজী’ নামক প্রস্রবণের নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদেরকে হামলা করে। যুদ্ধে আছেম সহ আটজন শহীদ হন এবং দুজন কে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা হলেন হযরত খোবায়েব বিন আদী ও যায়েদ বিন দাছনা।
সেখানে ওকবা বিন হারেছ খোবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা হিসাবে। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন।
অতঃপর কাফেরদের বদ দো‘আ করেন এবং সাত লাইনের মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। খোবায়েবের বদ দো‘আ ছিল নিম্নরূপ- ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও বাকী রেখো না’। [2]
৭। সারিইয়া বিরে মাঊনা:
৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। পূর্বোক্ত ঘটনাটির চাইতে এটি ছিল আরও বেশী মর্মন্তুদ এবং দু’টি ঘটনা একই মাসে সংঘটিত হয়। নাজদের নেতা আবু বারা আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য মুনযির বিন আমের (রাঃ)-এর নেতৃতেব ৭০ জনের একটি দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। মাঊনা নামক কুয়ার নিকটে পৌঁছলে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান (চতুর্দিক হ’তে তাদের উপরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে হত্যা করে।
একমাত্র আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে উঠিয়ে আনা হয়। এই সময় রাসূলের পত্র বাহক হারাম বিন মিলহানকে প্রাপক গোত্র নেতা আমের বিন তোফায়েল-এর ইংগিতে অতর্কিতে পিছন থেকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করা হলে তিনি বলে ওঠেন, ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সুলমা -এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি মদীনায় গিয়ে রাসূলের নিকটে ইসলাম কবুল করেন। [3]
মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর দু’টি হৃদয় বিদারক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দারুনভাবে ব্যথিত হন এবং বনু লেহিয়ান, রে‘ল ও যাকওয়ান এবং উছাইয়া গোত্র সমূহের বিরুদ্ধে এক মাস যাবত বদ দো‘আ করে ফজরের ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।
৮। গাযওয়া বনু নাযীর:
৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। মদীনার মুনাফিক ও মক্কার কুরায়েশ নেতাদের চক্রান্তে বনু নাযীরের ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলে তারা তাঁকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রেখে দেওয়ালের উপর থেকে পাথর ফেলে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তখন সেখান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। অতঃপর ছয় বা পনের দিন অবরোধের পরে তারা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে মদীনা থেকে চিরদিনের মত বহিষ্কার করা হয় ও তারা খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা হাশর নাযিল হয়। এই যুদ্ধে ফাই-য়ের বিধান নাযিল হয়।
৯। গাযওয়া আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধ:
৫ম হিজরীর শওয়াল ও যুলক্বা‘দাহ মাস। বিতাড়িত বনু নাযীর ইহুদী গোত্রের নেতাদের উস্কানীতে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কেনানাহ ও তেহামার মিত্র গোত্র সমূহ মিলে ৪০০০ কুরায়েশ বাহিনী এবং বনু গাত্বফান ও নাজদীদের ৬০০০ সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনীর ১০,০০০ সৈন্য মদীনা অবরোধ করে। যা ছিল মদীনার মোট লোকসংখ্যার চাইতে বেশী। কিন্তু সালমান ফারেসীর পরামর্শক্রমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনার উত্তর পার্শ্বে ওহোদের দিকে দীর্ঘ খন্দক বা পরিখা খনন করে তার পিছনে ৩০০০ সৈন্য সমাবেশ করেন।
এই নতুন কৌশল দেখে কাফের বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। পরিখা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে উভয় পক্ষে তীর চালনায় ৬ জন মুসলিম ও ১০ জন কাফির মারা যায়। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় এক মাস অবরোধে খাদ্যকষ্টে পতিত কাফের বাহিনীর উপরে হঠাৎ একরাতে উত্তপ্ত বায়ুর ঝড় নেমে আসে। তাতে তাদের তাঁবু সমূহ উড়ে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যায়। সম্মিলিত বাহিনীর এই পরাজয়ের ফলে সমগ্র আরবে মদীনা রাষ্ট্রের সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং সম্ভাব্য শত্রুরা মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। কেননা আহযাব যুদ্ধের ন্যায় বিশাল বাহিনীর সমাবেশ ঘটানো পুনরায় আরবদের জন্য সম্ভবপর ছিল না।
১০। গাযওয়া বনু কুরায়যা:
৫ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ ও যিলহাজ্জ মাস। মদীনার সর্বশেষ এই ইহুদী গোত্রটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে আহযাব যুদ্ধে আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় ও তাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করে। বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাবের প্ররোচনায় তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। আহযাব যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন যুলক্বা‘দাহ মাসের শেষ সপ্তাহের বুধবারে।
এসে যোহরের সময় যখন তিনি উম্মে সালামার গৃহে গোসল করছিলেন, তখন জিব্রীলের আগমন ঘটে এবং তাকে তখনই বনু কুরায়যার উপরে হামলা পরিচালনার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনি দ্রুত আসুন! আমি আগে গিয়ে দুর্গে কম্পন সৃষ্টি করে ওদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাথে সাথে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, যেন সবাই বনু কুরায়যায় গিয়ে আছর পড়ে। এই সময় রাসূলের সাথে ৩০০০ সৈন্য ছিলেন।
২৫ দিন অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের মিত্র সা‘দ বিন মু‘আযের সিদ্ধান্ত মতে তাদের বয়স্ক পুরুষ বন্দী ছয় থেকে সাত শতের মত লোককে হত্যা করা হয়। বাকীদের বহিষ্কার করা হয়। এই অবরোধকালে মুসলিম পক্ষে একজন শহীদ ও একজন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) মৃত্যু বরণ করেন। যিনি ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন।
১১। গাযওয়া হুদায়বিয়া:
৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ মদীনা হতে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন।
অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। এই সময় ‘আসফান’ নামক স্থানে সর্বপ্রথম ছালাতুল খাওফের হুকুম নাযিল হয় (নিসা ১০১-১০২)। কেননা খালেদ বিন ওয়ালীদ আছরের ছালাতের সময় ছালাতরত অবস্থায় মুসলমানদের উপরে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, খালিদ তখনও মুসলমান হননি।
১২। গাযওয়া খায়বর:
৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদের নেননি। এতে মুসলিম পক্ষে ১৮ জন শহীদ ও ৫০ জন আহত হন। ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়।
ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনীমত লাভ হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফিদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইছাহ বিন মাসঊদকে প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পরে তারা নিজেরা রাসূলের নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূলের দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফিদাক ভূমি কেবল রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।
১৩। সারিইয়া মুতা:
৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাস। রোম সম্রাট ক্বায়ছারের পক্ষ হ’তে সিরিয়ার বালক্বায় নিযুক্ত গবর্ণর শোরাহবীল বিন আমর আল-গাসসানীর নিকটে পত্র সহ প্রেরিত রাসূলের দূত হারেছ বিন উমায়ের আযদীকে হত্যা করা হয়। যা ছিল তৎকালীন সময়ের রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। অতএব যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরিত হয়। পক্ষান্তরে শোরাহবীলের ছিল প্রায় ২ লাখ সৈন্যের এক বিশাল খৃষ্টান বাহিনী।
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী ‘মুতা’ নামক স্থানে সংঘটিত এই যুদ্ধে সেনাপতি যায়েদ বিন হারেছাহ, অতঃপর সেনাপতি জাফর বিন আবু ত্বালিব, অতঃপর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা পরপর শহীদ হলে সকলের ঐক্যমতে খালিদ বিন ওয়ালীদ সেনাপতি হন। তিনি সম্মুখের দলকে পিছনে, পিছনের দলকে সম্মুখে ডাইনের দলকে বামে এবং বামের দলকে ডাইনে নিয়ে এক অপূর্ব রণকৌশলের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে সসম্মানে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন।
নতুন সেনাদল যুক্ত হয়েছে ভেবে এবং মুসলমানেরা তাদেরকে মরু প্রান্তরে নিক্ষেপ করবে সেই ভয়ে রোমানরা পিছু হটে যায়। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১২ জন শহীদ হন। রোমক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একা খালেদ বিন ওয়ালীদের যেখানে নয় খানা তরবারি ভেঙ্গেছিল, তাতে অনুমান করা চলে কত সৈন্য তাদের ক্ষয় হয়েছিল।
১৪। গাযওয়া ফাৎ হে মাক্কা বা মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ:
৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ ছাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা হ’তে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার আকস্মিকভাবে মক্কায় উপস্থিত হন ও একপ্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়।
মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-ক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করার অপরাধেই কুরায়েশদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
১৫। গাযওয়া হোনায়েন বা হুনায়েন যুদ্ধ:
৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হ’তে আরাফাতের দিকে ২৬ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে হুনায়েন উপত্যকায় মালেক বিন আওফের নেতৃত্বে ৪০০০ দুঃসাহসী সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাওয়াল শনিবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার ২০০০ নও মুসলিম সহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হুনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষে ৭১ জন নিহত হয় ও মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন। যুদ্ধে বিশাল পরিমাণের গনীমত হস্তগত হয়।
১৬। গাযওয়া ত্বায়েফ:
৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হুনায়েন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নেতা মালেক বিন আওফ সহ পরাজিত ছাক্বীফ গোত্রের লোকেরা পালিয়ে গিয়ে ত্বায়েফের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমে খালিদের নেতৃত্বে ১০০০-এর একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে গমন করেন। তারা তায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ কতদিন স্থায়ী ছিল এ বিষয়ে ১৫ দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত মতামত রয়েছে।
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জনের অধিক শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। এ সময় ছাহাবীগণ তাঁকে ছাক্বীফ গোত্রের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আবেদন জানালে তিনি উত্তম দো‘আ করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো’। [18] আল্লাহ সেটাই কবুল করলেন এবং কিছুদিন পর তারা নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করল।
১৭। গাযওয়া তাবূক:
৯ম হিজরীর রজব মাস। এটাই ছিল রাসূলের জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ সময় মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।
অভিযান সমূহ পর্যালোচনা:
অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে ৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৮৬-এর মধ্যে ৬টি অভিযান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৩৭ নং সারিইয়াহ তিনটি ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। বদর সহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।
শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صابئي) বা বিধর্মী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস গত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা। সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার।
কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে নিতান্তই অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহুদী নেতারা ও অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ মূলক।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি হয় তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে এবং অবিরত ভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে। খৃষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না।মুতার যুদ্ধ ছিল সিরিয়া অঞ্চলে রোমক গবর্ণর শোরাহবীলের মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে। তাবূক যুদ্ধ ছিল আগ্রাসী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।
পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ উভয় প্রকারের। যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।
ফুটনোট:
[1] রহমাতুল লিল আলামীন ১/১৩০।
[2] বুখারী হা/৩৯৮৯।
[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৪।
[4] মুসলিম ২/৮৯।
[5] মুসলিম, আনাস হ’তে ২/৮৯ পৃঃ।
[6] বুখারী ২/৬২৫ ও মুসলিম ২/১৪৫। মুবারকপুরী বলেন যে, চরিতকারগণ এটিকে ৮ম হিজরীর রজব মাসের ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক (السياق) বিবেচনায় দেখা যায় যে, এটি হুদায়বিয়ার পূর্বের ঘটনা। কেননা ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল ক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পরে কুরায়েশ কাফেলাকে হামলা করার জন্য আর কোন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়নি’।
[7] বুখারী, মানছূরপুরী এটা ধরেননি।
[8] বুখারী ২/৫৯২; মুসলিম ২/১১৮।
[9] মুবারকপুরী এটা ধরেননি। মানছুরপুরী সাল-তারিখ ও সেনা সংখ্যা বলেননি।
[10] মানছূরপুরী মুনক্বা‘আহ (منقعة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন, ৩/১৯৭।
[11] মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/১৫২২ সনদ হাসান; মুসলিম হা/২৭৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ৪৩ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৬৮৭২-এর ব্যাখ্যা, ফাৎহুল বারী ১২/২০৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৫০, ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়; মানছূরপুরী এটাকে পৃথক ‘খারবাহ অভিযান’ (سرية خربة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৭।
[12] মানছূরপুরী এটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস লিখেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৫।
[13] কিন্তু মানছূরপুরী বলেন যে, মুসলিম বাহিনীর ১ জন আহত ও ৪৯ জন শহীদ হন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৮।
[14] নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।
[15] আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান।
[16] বুখারী হা/৪৩৩৯; মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৩১; ছাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদায় বর্ণিত উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৮৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৯৮৬।