আলোর বেগ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক যে কারণে? (Latest Update)
আলোর বেগ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক। সসীম না অসীম? গ্যালিলিও গ্যালিলি সে জন্য একটা পরীক্ষার কথা ভাবলেন। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান মিলল ওলে রোমারের হাত ধরে। ঝড় ও বজ্রপাতের সময় আকাশ চেরা বিদ্যুৎ ঝলক কে না দেখেছে! এককালে একে দেবতাদের রোষ বলে বিশ্বাস করত মানুষ। কিন্তু বিজ্ঞান এসব কুসংস্কার দূর করেছে অনেক আগেই।
আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে, বিদ্যুৎ ঝলক আসলে একধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের ভয়াবহ এক খেলা। এই প্রবাহ মেঘ থেকে ভূপৃষ্ঠে কিংবা এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে ছুটে যায় চোখের পলকে। তাতেই দেখা যায় আচমকা আলোর ঝলক। তার কিছুক্ষণ পরই শোনা যায় কান ফাটানো গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ।
বজ্রপাত একদম কাছে হলে বিদ্যুৎ ঝলকের আলো দেখা এবং ওই শব্দ শোনা যায় প্রায় একই সময়ে। সে শব্দ কান ফাটানো। মেঘ গর্জনের মতো উচ্চনাদে। একে আমাদের দেশে বলা হয় মেঘ ডাকা। অবশ্য বজ্রপাতের আলো দেখা ও শব্দ শোনা—এই দুইয়ের মধ্যে সময়ের কিছুটা হেরফের থাকে। কিন্তু বজ্রপাত অনেক দূরে হলে, আলোর ঝলক খুব বেশি উজ্জ্বল দেখায় না। শব্দও শোনা যায় কম। তার ওপর শব্দটা শোনা যায় বেশ কিছুক্ষণ পরে। প্রশ্ন আসতে পারে, দূরের বজ্রপাতের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ঝলক দেখার পর, বাজ পড়ার শব্দ শুনতে কিছুটা সময় লাগে কেন?
এর কারণ, শব্দ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সময় নেয়। শব্দের বেগ মেপে দেখা গেছে, বায়ু মাধ্যমে এর বেগ ঘন্টায় ১ হাজার ১৯০ কিলোমিটার (বা প্রায় ৭৪০ মাইল)। মানে, এক সেকেন্ডে শব্দ পেরোতে পারে প্রায় ৩৩১ মিটার (বা ১ হাজার ৮৬ ফুট) দূরত্ব। এভাবে মাত্র পাঁচ সেকেন্ডে শব্দ পাড়ি দিতে পারে প্রায় এক মাইল বা ১.৬৫ কিলোমিটার।
তাহলে এক মাইল দূরে কোথাও বজ্রপাত আঘাত হানলে, সেই বজ্রধ্বনি শুনতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ সেকেন্ড। কারণ এই পাঁচ সেকেন্ড পরেই কেবল শব্দটা কানে এসে পৌঁছাতে পারবে। বজ্রপাতটা যদি দুই মাইল দূরে আঘাত হানে, তাহলে তা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১০ সেকেন্ড। আলোর ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটে? আলোও কি আমাদের কাছে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নেয়?
হয়তো তাই ঘটে। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলেও তা চলাচল করে অবশ্যই শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে। কারণ আমরা নিশ্চিত জানি, বজ্রপাতের শব্দের চেয়ে আলোটা বেশ কিছুক্ষণ আগে দেখা যায়। সেটা না হয় মানলাম, কিন্তু আলোর বেগ আসলে কত? সেই বেগ কি মাপার কোনো উপায় আছে?
এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বির্তক দীর্ঘদিনের। সেই প্রাচীনকাল থেকে। সেকালে সাধারণভাবে মনে করা হতো, আলোর বেগ মাপা সম্ভব নয়। সে যুগের কয়েকজন পণ্ডিত বিশ্বাস করতেন, আলো এত দ্রুত চলাচল করে যে দূরত্ব যতই হোক না কেন, তা যেকোনো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে চোখের পলকে। এভাবে গ্রিক পণ্ডিতদের ধারণা হয়েছিল, আলোর বেগ সম্ভবত ‘অসীম’। অর্থাৎ আমরা যে গতি বা বেগ কল্পনা করতে পারি, আলোর বেগ তার চেয়ে অনেক বেশি। এমন ভাবনা ছিল গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলেরও।
তবে পরিস্থিতি বদলে যায় মধ্যযুগে এসে। এ সময় আলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন আরবের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইবনে সিনা এবং ইবনে আল হাইসাম (পুরো নাম, আবু আলি আল হাসান ইবনে আল হাইসাম। ‘আল হাসান’ ইংরেজিতে এসে ‘আল হাজেন’ হয়ে গেছে। অনেকের কাছে তিনি এই আল হাজেন নামে পরিচিত)। ১০২১ সালে আলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ইবনে আল হাইসামের লেখা কিতাব আল মানজির নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। সেটি ইউরোপের বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত বুক অব অপটিকস নামে।
এ বইয়ে আল হাজেন আলো সম্পর্কে গ্রিকদের অনেক ভুল ধারণা যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে খণ্ডন করেন। পাশাপাশি যুক্তি দেখান, আলোর বেগ অসীম নয়, সসীম। ঘনবস্তুতে আলোর বেগ কম বলেও যুক্তি দেন তিনি। ১১ শতকে একই মত প্রকাশ করেন আরবের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী আবু রায়হান আল বিরুনিও। তবে এদের কেউই আলোর সত্যিকারের বেগ মেপে দেখার চেষ্টা করেননি।