মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মক্কা বিজয়
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মক্কা বিজয়
★★★ (৮ম হিজরী ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার; ৬৩০ খৃঃ, ১লা জানুয়ারী)
জন্মভূমি মক্কা হতে হিজরত করার প্রায় আট বছর পর বিজয়ীর বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, নবীকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করলেন।
এতদিন যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ। বিজয়ী রাসূল (সাঃ) তাদের কারু প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপরে কোনরূপ অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’।
অভিযানের কারণ:
প্রায় দু’বছর পূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সম্পাদিত হোদায়বিয়াহর চার দফা সন্ধিচুক্তির তৃতীয় দফায় বর্ণিত ছিল যে, ‘যে সকল গোত্র মুসলমান বা কুরায়েশ যে পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে এবং তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট দলের উপরে অত্যাচার বলে ধরে নেওয়া হবে’। উক্ত শর্তের আওতায় মক্কার নিকটবর্তী গোত্র বনু খোযা‘আহ মুসলমানদের সাথে এবং বনু বকর কুরায়েশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট দলের মিত্রপক্ষ হিসাবে গণ্য হয়।
কিন্তু দু’বছর পুরা না হতেই বনু বকর উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করল এবং ৮ম হিজরীর শা‘বান মাসে রাত্রির অন্ধকারে বনু খোযা‘আহর উপরে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বহু লোককে হতাহত করল। ঐসময় বনু খোযা‘আহ গোত্র ‘ওয়াতীর’ নামক প্রস্রবনের ধারে বসবাস করত, যা ছিল মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত (মু‘জামুল বুলদান)। বনু বকরের এই অন্যায় আক্রমনে কুরায়েশদের ইন্ধন ছিল।
তারা অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এমনকি কুরায়েশ নেতা ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং খোদ হোদায়বিয়া সন্ধিচুক্তিতে কুরায়েশ পক্ষের আলোচক ও স্বাক্ষর দানকারী সোহায়েল বিন আমর সশরীরে উক্ত হামলায় অংশগ্রহণ করেন (তারীখে ত্বাবারী)। [1]
বনু খোযা‘আহ গোত্রের এই হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ নিয়ে আমের ইবনু সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জনের একটি দল সহ দ্রুত মদীনায় আসেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন মসজিদে নববীতে ছাহাবায়ে কেরাম সহ অবস্থান করছিলেন।
বনু খোযা‘আহর আবেদনে রাসূলের সাড়া:
আমর ইবনু সালেম-এর মর্মস্পর্শী কবিতা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে ওঠেন ‘তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছ হে আমর ইবনু সালেম’! এমন সময় আসমানে একটি মেঘখন্ডের আবির্ভাব হয়। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘এই মেঘমালা বনু কা‘বের সাহায্যের শুভসংবাদে চমকাচ্ছে’।
এরপর বনু খোযা‘আহর আরেকটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বুদাইল বিন অরক্বা আল-খোযাঈ আগমন করেন এবং তাদের গোত্রের কারা কারা নিহত হয়েছে ও কুরায়েশরা কিভাবে বনু বকরকে সাহায্য করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ পেশ করেন। অতঃপর তারা মক্কায় ফিরে যান। [4]
রাসূলের পরামর্শ বৈঠক:
সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের পর করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। এক সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলে ওঠেন, ‘আমি যেন তোমাদেরকে আবু সুফিয়ানের সাথে দেখছি যে, সে মদীনায় আসছে তোমাদের কাছে চুক্তি পাকাপোক্ত করার জন্য এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্য’। [5]
আবু সুফিয়ানের মদীনা আগমন ও আশ্রয় প্রার্থনা:
দূরদর্শী আবু সুফিয়ান বুঝেছিলেন যে, বনু খোযা‘আহর উপরে এই কাপুরুষোচিত আক্রমণ হোদায়বিয়াহর সন্ধিচুক্তির স্পষ্ট লংঘন এবং এর প্রতিক্রিয়া হল মুসলমানদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণ, যা ঠেকানোর ক্ষমতা এখন তাদের নেই। তাই তিনি মোটেই দেরী না করে এবং কোন প্রতিনিধি না পাঠিয়ে কোরায়েশ নেতাদের পরামর্শক্রমে সরাসরি নিজেই মদীনা গমন করলেন।
পথিমধ্যে খোযা‘আহ নেতা বুদাইল বিন অরক্বার সঙ্গে আসফান নামক স্থানে সাক্ষাত হলে তিনি মুহাম্মাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু সুচতুর আবু সুফিয়ান বুদাইলের উটের গোবরের মধ্যে খেজুরের আঁটি পরীক্ষা করে বুঝে নেন যে, বুদাইল মদীনা গিয়েছিল। এতে তিনি আরো ভীত হয়ে পড়েন।
যাইহোক মদীনা পৌঁছে তিনি স্বীয় কন্যা উম্মুল মুমেনীন উম্মে হাবীবাহর সাথে সাক্ষাত করেন। এসময় তিনি খাটে বসতে উদ্যত হলে কন্যা দ্রুত বিছানা গুটিয়ে নেন ও বলেন, ‘এটি রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা। এখানে আপনার বসার অধিকার নেই। কেননা আপনি অপবিত্র মুশরিক’। অতঃপর আবু সুফিয়ান বেরিয়ে জামাতা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলেন ও সব কথা বললেন।
কিন্তু রাসূল (সাঃ) কোন কথা বললেন না। নিরাশ হয়ে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাকে রাসূলের নিকটে কথা বলার অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। অতঃপর ওমরের কাছে গিয়ে একইভাবে তোষামোদ করলেন।
কিন্তু ওমর কঠোর ভাষায় জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের নিকটে সুফারিশ করব? আল্লাহর কসম! যদি আমি কিছুই না পাই ছোট নুড়ি ছাড়া, তাই দিয়ে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব’।
এবার সবশেষে তিনি আলী (রাঃ)-এর কাছে গেলেন। এ সময় সেখানে ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন এবং তাদের সামনে শিশু হাসান লাফালাফি করে খেলছিলেন। আবু সুফিয়ান সেখানে পেঁŠছে আলী (রাঃ)-কে অত্যন্ত বিনয়ের সুরে বললেন, হে আলী! অন্যদের তুলনায় তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক অনেক গভীর। আমি একটি বিশেষ প্রয়োজনে মদীনায় এসেছি।
এমনটি যেন না হয় যে, আমাকে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। ‘তুমি আমার জন্য মুহাম্মাদের নিকটে সুফারিশ কর’। জবাবে আলী (রাঃ) বললেন,‘তোমাদের জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একটি বিষয়ে কৃত সংকল্প হয়েছেন, যে বিষয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি না’।
রাসূলের গোপন প্রস্তুতি:
ত্বাবারাণী হাদীছ গ্রন্থের বর্ণনাসূত্রে জানা যায় যে, কুরায়েশদের চুক্তি ভঙ্গের খবর পৌঁছবার তিন দিন আগেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্ত্রী আয়েশাকে সফরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দেন- যা কেউ জানত না। পিতা আবুবকর (রাঃ) কন্যা আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে কন্যা! এসব কিসের প্রস্তুতি? কন্যা জবাব দিলেন و‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না’।
আবুবকর (রাঃ) বললেন, এখন তো রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রাসূল (সাঃ) কোন দিকের এরাদা করেছেন? আয়েশা (রাঃ) আবার বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই’। দেখা গেল যে, তৃতীয় দিন আমর ইবনু সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে হাযির হলেন। তখন লোকেরা চুক্তিভঙ্গের খবর জানতে পারল। [6]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে মক্কা গমনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করলেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরায়েশদের নিকটে গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং এই অভিযানের খবর পৌঁছানোর পথ সমূহ বন্ধ করে দাও। যাতে তাদের অজান্তেই আমরা তাদের শহরে হঠাৎ উপস্থিত হতে পারি’। [7]
অতঃপর বাহ্যিক কৌশল হিসাবে তিনি আবু ক্বাতাদাহ হারেছ বিন রিব্‘ঈ -এর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি দলকে ১লা রামাযান তারিখে ‘ইযাম’ উপত্যকার দিকে রওয়ানা করে দেন। যাতে শত্রুরা ভাবে যে, অভিযান ঐদিকেই পরিচালিত হবে। পরে তারা গিয়ে রাসূল (সাঃ-এর সাথে মিলিত হন। [8]
অভিযান পরিকল্পনা ফাঁসের ব্যর্থ চেষ্টা ও চিঠি উদ্ধার:
বদর যুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ ছাহাবী এবং রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদকারী উৎবা বিন আবী ওয়াকক্বাছের হত্যাকারী প্রসিদ্ধ বীর হযরত আবু বালতা‘আহ (রাঃ) রাসূলের আসন্ন মক্কা অভিযানের খবর দিয়ে একটি পত্র লিখে এক মহিলার মাধ্যমে গোপনে মক্কায় প্রেরণ করেন।
অহি-র মাধ্যমে খবর অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আলী ও মিক্বদাদ (রাঃ)-কে দ্রুত পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমরা ‘খাখ’ নামক বাগিচায় গিয়ে একজন হাওদা নশীন মহিলাকে পাবে, যার কাছে কুরায়েশদের নিকটে লিখিত একটি পত্র রয়েছে’। তারা অতি দ্রুত পিছু নিয়ে ঠিক সেখানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন ও তাকে পত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন।
মহিলা অস্বীকার করলে তার হাওদা তল্লাশি চালানো হল। কিন্তু না পেয়ে হযরত আলী তাকে বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিথ্যা বলেননি, আল্লাহর কসম! অবশ্যই তুমি চিঠিটি বের করে দেবে, নইলে অবশ্যই আমরা তোমাকে উলঙ্গ করব’। তখন মহিলা ভয়ে তার মাথার খোঁপা থেকে চিঠিটা বের করে দিল। পত্রখানা নিয়ে তারা মদীনায় ফিরে এলেন।
তখন হাতেবকে ডেকে রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে বিশ্বাসী। আমি ধর্মত্যাগী হইনি বা আমার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তনও আসেনি’। তবে ব্যাপারটি হল এই যে, আমি কুরায়েশদের সাথে সম্পৃক্ত একজন ব্যক্তি মাত্র। তাদের গোত্রভুক্ত নই।
অথচ তাদের মধ্যে রয়েছে আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সন্তান-সন্ততি। তাদের সাথে আমার কোন আত্মীয়তা নেই, যারা তাদের হেফাযত করবে। অথচ আপনার সাথে যেসকল মুহাজির আছেন, তাদের সেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে, যারা তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। এজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, তাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখাই, যাতে তারা আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়’। তখন ওমর (রাঃ) বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দিই।
কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করেছে এবং সে অবশ্যই মুনাফেকী করেছে’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল’। তোমার কি জানা নেই হে ওমর! আহলে বদর সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা খুশী করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি’। একথা শুনে ওমরের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত’। [9]
মক্কার পথে রওয়ানা:
৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ সাথী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় মদীনার দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে যান আবু রুহম কুলছূম আল-গেফারী (রাঃ) -কে। [10]
মুসলিম বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে:
১৭ই রামাযান মঙ্গলবার সকালে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মার্রুয যাহরান ত্যাগ করে মক্কায় প্রবেশের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তিনি আববাসকে বললেন যে, আপনি আবু সুফিয়ানকে (আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীর অবস্থান পরিদর্শন কালে বন্দী হাওয়ার আগমুহূর্তে আব্বাস (রাঃ) নিরাপত্তা দেন এবং পরে আবু সুফিয়ান আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এর কাছে ইসলাম গ্রহন করে) নিয়ে উপত্যকা থেকে বের হওয়ার মুখে সংকীর্ণ পথের পার্শ্বে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যাতে সে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে।
আববাস (রাঃ) তাই-ই করলেন। এরপর যখনই স্ব স্ব গোত্রের পতাকা সহ এক একটি গোত্র ঐ পথ অতিক্রম করে, তখনই আবু সুফিয়ান আববাসের নিকটে ঐ গোত্রের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। যেমন আসলাম, গেফার, জোহায়না, মুযায়না, বনু সোলায়েম ও অন্যান্য গোত্র সমূহ। কিন্তু আবু সুফিয়ান ঐসব লোকদের তেমন মূল্যায়ন না করে বলেন, এদের সাথে আমার কি সম্পর্ক?
এরপরে যখন আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে একটি বিরাট দলকে আসতে দেখলেন তখন আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ হে আববাস এরা কারা? আববাস (রাঃ) বললেন, মুহাজির ও আনছার বেষ্টিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আসছেন’।
আবু সুফিয়ান বললেন, ‘কারু পক্ষে এদের সাথে মুক্বাবিলার শক্তি হবে না’। অতঃপর বললেন, হে আবুল ফযল! ‘তোমার ভাতিজার সাম্রাজ্য তো আজকে অনেক বড় হয়ে গেছে’। আববাস (রাঃ) বললেন, ‘হে আবু সুফিয়ান, এটা (রাজত্ব নয় বরং) নবুঅত’। আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হাঁ, তাহলে তাই’। [15]
সা‘দের পতাকা হস্তান্তর : এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যায়। আনছারদের পতাকা ছিল খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর হাতে। তিনি ইতিপূর্বে ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলেন, ‘আজ হল মারপিটের দিন। আজ হারামকে হালাল করা হবে। আজ আল্লাহ কুরায়েশকে অপদস্থ করবেন’। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শুনেছেন সা‘দ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন কি বলেছে?
তখন তাকে সব বলা হল। সেকথা শুনে হযরত ওছমান ও আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, আমরা সা‘দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই। হয়ত সে কুরায়েশদের মারপিট শুরু করে দেবে’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘বরং আজকের দিনটি হবে কা‘বা গৃহের প্রতি যথার্থ মর্যাদা প্রদর্শনের দিন। আজকের দিনটি হবে সেই দিন, যেদিন আল্লাহ কুরায়েশ বংশের যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন’। [16]
অতঃপর তিনি একজনকে পাঠিয়ে সা‘দের নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তার পুত্র ক্বায়েমকে দিলেন। যাতে সে বুঝতে পারে যে, পতাকা তার হাত থেকে বাইরে যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, পতাকাটি যুবায়ের (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
মুসলিম বাহিনী কুরায়েশদের মাথার উপরে:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অতিক্রম করে যাওয়ার পর হযরত আববাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘তোমার কওমের দিকে দৌঁড়াও’। আবু সুফিয়ান অতি দ্রুত মক্কায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন,‘হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ এসে গেছেন, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। অতএব যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’।
এ ঘোষণা শুনে তার স্ত্রী হিন্দা এসে তার মোচ ধরে বলে ওঠেন, এই চর্বিওয়ালা শক্ত মাংসধারী মশকটাকে তোমরা মেরে ফেল। এরূপ দুঃসংবাদ দানকারীর মন্দ হৌক’! আবু সুফিয়ান বললেন, তোমরা সাবধান হও! এই মহিলা যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে। লোকেরা বলল, হে আবু সুফিয়ান! তোমার ঘরে কয়জনের স্থান হবে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ থাকবে’। একথা শোনার পর লোকেরা স্ব স্ব ঘর ও বায়তুল্লাহর দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল। [17]
কিন্তু কিছু সংখ্যক নির্বোধ লোক ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া, সোহায়েল বিন আমর প্রমুখের নেতৃত্বে মক্কার ‘খান্দামা’পাহাড়ের কাছে গিয়ে জমা হল মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য। [18]
খান্দামায় মুকাবিলা ও হতাহতের ঘটনা:
মুসলিম বাহিনী খান্দামায় পৌঁছানোর পর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ ইবনে ওয়ালীদের সাথে তাদের মুকাবিলা হয়। তাতে ১২ জন নিহত হওয়ার পর তাদের মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এই সময় খালেদ বাহিনীর দু’জন শহীদ হন, যারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা হলেন কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী এবং খুনায়েস বিন খালেদ বিন রাবী‘আহ। [19]
অতঃপর খালেদ মক্কার গলিপথ সমূহ অতিক্রম করে ছাফা পাহাড়ে উপনীত হলেন। অন্যদিকে বামবাহুর সেনাপতি যোবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ) মক্কার উপরিভাগ দিয়ে প্রবেশ করে হাজূন নামক স্থানে অবতরণ করলেন। একইভাবে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ পদাতিক বাহিনী নিয়ে বাত্বনে ওয়াদীর পথ ধরে মক্কায় পৌঁছে যান।
বিজয়ীর বেশে রাসূলের মক্কায় প্রবেশ:
অতঃপর আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন ও হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন। এই সময় কা‘বা গৃহের ভিতরে ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাতের ধনুক দ্বারা এগুলি ভাঙতে শুরু করেন এবং কুরআনের এ আয়াত পড়তে থাকেন-
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا
‘তুমি বল, হক এসে গিয়েছে, বাতিল অপসৃত হয়েছে’। নিশ্চয়ই বাতিল অপসৃত হয়েই থাকে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮১)।
তিনি আরও পড়েন,
قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيْدُ
‘তুমি বল হক এসে গেছে এবং বাতিল না শুরু হবে, না আর ফিরে আসবে’ (সাবা ৩৪/৪৯)।
অর্থাৎ সত্যের মুকাবিলায় মিথ্যা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয় যে, তা কোন বিষয়ের সূচনা বা পুনরাবৃত্তির যোগ্য থাকে না। অতঃপর ওছমান বিন ত্বালহাকে ডেকে তার কাছ থেকে কা‘বা ঘরের চাবি নিয়ে দরজা খুলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ভিতরে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে বহু মূর্তি ও ছবি দেখতে পান। অতঃপর তিনি সমস্ত ছবি-মূর্তি নিশ্চিহ্ন করে ফেলার নির্দেশ দেন এবং সাথে সাথে তা পালিত হয়। [20]
অতঃপর তিনি ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখেন ও সর্বত্র আল্লাহু আকবর ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে থাকেন। অতঃপর তিনি দরজা খুলে দেন। এ সময় হাযার হাযার লোক কা‘বা গৃহের সম্মুখে দন্ডায়মান ছিল।
রাসূলের ১ম দিনের ভাষণ : অতঃপর তিনি দরজার দুই পাশ ধরে নীচে দন্ডায়মান কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সেনাদলকে একাই পরাভূত করেছেন’। শুনে রাখ, সম্মান ও সম্পদের সকল অহংকার এবং রক্তারক্তি আমার পদতলে নিষ্পেষিত হল।
কেবলমাত্র বায়তুল্লাহর চাবি সংরক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর সম্মানটুকু ছাড়া (অর্থাৎ এ দু’টি দায়িত্ব তোমাদের জন্য বহাল রইল)। ভুলবশত হত্যা যা লাঠিসোটা দ্বারা হয়ে থাকে, তা ইচ্ছাকৃত হত্যার সমতুল্য , তাকে পূর্ণ রক্তমূল্য দিতে হবে একশ’টি উট। যার মধ্যে ৪০টি হবে গর্ভবতী। [24]
‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগ্য। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-
‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃজন করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বকিছু খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। [25]
অতঃপর বললেন, ‘হে কুরায়েশগণ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’? সবাই বলে উঠল, ‘উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’। [26]
কেননা ঐ দিন কাউকে বন্দী করা হয়নি বা গণীমত সংগ্রহ করা হয়নি। বরং সবাই মুক্ত ছিল এবং উপস্থিত সবাই বায়‘আত নিয়ে ইসলাম কবুল করেছিল।
ফুটনোট:
[1] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২০৯।
[2] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৪-৯৫।
[3] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯।
[4] বায়হাক্বী, যাদুল মা‘আদ৩/৩৪৯।
[5] বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/১৭৫৭, ‘সনদ মুরসাল।
[6] ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০৫২; ঐ, ছগীর হা/৯৬৮; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫১।
[7] ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৭৫, সনদ যঈফ।
[8] ওয়াক্বেদী, কিতাবুল মাগাযী, ‘মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ, ২/৩২৩; আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ।
[9] বুখারী হা/৩৬৮৪ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
[10] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[11] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০০; আর-রাহীক্ব ৩৯৯ পৃঃ।
[12] হাকেম, ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৭৬, সনদ হাসান।
[13] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২-৩৫৩।
[14] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৩; মুসলিম, মিশকাত হা/৬২১০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[15] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৪; ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[16] বুখারী হা/৪২৮০।
[17] ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[18] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬-৫৭।
[19] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৭।
[20] বুখারী হা/৪২৮৮।
[21] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৯।
[22] ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৪, ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৫১।
[23] দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/১৫৯৮ ও ১৬০১ নং হাদীছ দ্বয়ের ব্যাখ্যা, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ৫১ ও ৫৪ অনুচ্ছেদ।
[24] আবুদাঊদ হা/৪৫৪৭ সনদ হাসান।
[25] তিরমিযী হা/৩২৭০ সনদ ছহীহ; আবু দাউদ হা/৫১১৬; ঐ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।
[26] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১২; ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৮২; যঈফাহ হা/১১৬৩, সনদ যঈফ।