মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর দাওয়াতের কার্যক্রম
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর দাওয়াতের কার্যক্রম
প্রকাশ্য দাওয়াতের সাধারণ প্রতিক্রিয়া:
প্রথমে ছাফা পর্বত চূড়ার আহবান মক্কানগরী ও তার আশপাশ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে এক নতুনের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। অতঃপর সর্বত্র প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়ায় সকলের মুখে মুখে একই কথার অনুবৃত্তি হতে থাকে, কি শুনছি আজ আমরা আব্দুল্লাহর পুত্রের মুখে। এযে নির্যাতিত মানবতার প্রাণের কথা। এযে মযলূমের হৃদয়ের ভাষা।
যে ক্রীতদাস ভাবত এটাই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে লাগল। যে নারী ভাবত, সবলের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে অধিকার সচেতন সাহসী নারী হিসাবে ভাবতে লাগল। যে গরীব ভাবত সূদখোর মহাজনের করাল গ্রাস হতে মুক্তির কোন পথ নেই, সে এখন মুক্তির দিশা পেল। সর্বত্র যেন একটা জাগরণের শিহরণ। এ যেন নিদ্রাভঙ্গের পূর্বক্ষণে ছুবহে ছাদিকের আগমন। ভারতের উর্দূ কবি আলতাফ হোসায়েন হালী (১৮৩৭-১৯১৪ খৃঃ) এই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
وه بجلى كا كڑكا تها يا صوت هادى عرب كى زمين جس نے سارى هلا دى
‘এটি বিদ্যুতের বজ্রধ্বনি ছিল, না পথপ্রদর্শকের ঘোষণা ছিল; আরবের মাটিকে যা নিমেষে কাঁপিয়ে দিল’।
সমাজ নেতাদের প্রতিক্রিয়া:
রাসূলের আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজ নেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে।
দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
তাওহীদের এ সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধী বিবেচনা করে তারা রাসূলের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ‘জ্ঞানের চূড়া’ বলে পরিচিত কুরায়েশ নেতা ‘আবুল হেকাম’ এরপর থেকে মুসলমানদের নিকটে ‘মূর্খতার চূড়া’ বা ‘আবু জাহল’ নামে পরিচিত হয়। আল্লাহ বলেন,
قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّال ِمِينَ بِآيَاتِ اللّهِ يَجْحَدُونَ-
‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)।
বিরোধিতার কৌশল সমূহ নির্ধারণ:
তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা উদ্ভাবন করল।
(১) আবু ত্বালেবকে দলে টানা:
প্রথম পন্থা হিসাবে বেছে নিল মুহাম্মাদের আশ্রয়দাতা আবু ত্বালেবকে দলে টানা। সেমতে নেতৃবৃন্দ সেখানে গেলেন এবং তাঁর নিকটে বাপ-দাদার ধর্মের দোহাই দিয়ে ও সামাজিক ঐক্য বিনষ্টের কথা বলে মুহাম্মাদকে বিরত রাখার দাবী জানালেন। আবু ত্বালিব স্থিরভাবে তাদের সব কথা শুনলেন। অতঃপর ধীরকণ্ঠে নরম ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন।
(২) হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধা দেওয়া:
হজ্জের মৌসুম সমাগত। অতএব এই সুযোগে মুহাম্মাদ বহিরাগতদের নিকটে তার দ্বীনের দাওয়াত পেশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। অতএব তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন একটা কথা মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তৈরী করতে হবে এবং তা সকলের মধ্যে প্রচার করে দিতে হবে, যাতে কোন লোক তার কথায় কর্ণপাত না করে। এক একজন এক এক প্রস্তাব করল। কেউ বলল, তাকে ‘কাহেন’ (ভবিষ্যদ্বক্তা) বলা হউক। কেউ বলল, ‘পাগল’ বলা হউক। কেউ বলল, ‘কবি’ বলা হউক।
সব শুনে দলনেতা অলীদ বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কথাবার্তা বড়ই সুন্দর ও মিষ্ট-মধুর। তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই লোকেদের নিকট তোমাদের দেওয়া ঐসব অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। তারা বলল, তাহলে আপনিই বলুন, কী বলা যায়। অলীদ অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে বলল, তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে বেশীর বেশী তাকে ‘জাদুকর’ বলা যায়।
কেননা তার কথা যেই-ই মন দিয়ে শোনে তার মধ্যে জাদুর মত আছর করে (মুদ্দাচ্ছির ৭৪/২৪) একসময় লোকেরা তার দলে ভিড়ে যায়। ফলে আমাদের পিতা-পুত্রের মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমনকি গোত্রে-গোত্রে বিভক্তি সৃষ্টি হয়ে গেছে।
ওইদিন অলীদের গৃহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাসূলকে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্তের ঘটনা এবং অলীদের বাকভঙ্গী আল্লাহ নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাবে-
إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ- فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ نَظَرَ- ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ- ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ- فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ يُّؤْثَرُ- إِنْ هَذَا إِ لاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ-
‘সে চিন্তা করল ও মনস্থির করল’। ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’? ‘অতঃপর সে তাকাল’। ‘অতঃপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল’। ‘অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল ও অহংকার করল’। ‘তারপর বলল, অর্জিত জাদু বৈ কিছু নয়’। ‘এটা মানুষের উক্তি বৈ কিছু নয়’(মুদ্দাছছির৭৪/১৮-২৫)।
মৌসুমে রাসূলের দাওয়াত:
যথা সময়ে হজ্জের মৌসুম এসে গেল। হজ্জের মাসের আগে-পিছে দুমাস হল হরমের মাস। এ তিন মাস মারামারি-কাটাকাটি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হজ্জে আগত মেহমানদের তাঁবুতে গিয়ে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। ওদিকে অলীদের পরামর্শ মতে আবু লাহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত গীবতকারী দল সবার কাছে গিয়ে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং শেষে বলে আসে যে, সে একজন জাদুকর।
তার কথা শুনলেই জাদুগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে। অতএব কেউ যেন তার ধারে কাছে না যায়। খোদ আবু লাহাব নির্লজ্জের মত রাসূলের পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। রাসূল (সাঃ) যেখানেই যান, সেখানেই সে গিয়ে বলে
لاَتُطِيْع ُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ‘
তোমরা কেউ এর কথা শুনো না। সে বেদ্বীন ও মিথ্যুক’।
শুধু তাই নয়, সে উপরোক্ত গালি দিয়ে হজ্জ মৌসুমের বাইরে যুল-মাজাযের বাজারে রাসূলের পায়ে সজোরে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। যাতে তাঁর গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।
লাভ ও ক্ষতি:
এই ব্যাপক অপপ্রচারের ফলে রাসূলের জন্য লাভ ও ক্ষতি দু’টিই হ’ল। লাভ হ’ল এই যে, তাঁর নবুঅত দাবীর কথা সর্বত্র প্রচারিত হল। পক্ষান্তরে ক্ষতি হল এই যে, একজন লোকও তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং অনেকের মধ্যেই তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হল। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক ছিল আবু লাহাবের নোংরা প্রচারণা।
কেননা সে ছিল রাসূলের আপন চাচা, নিকটতম প্রতিবেশী, তাঁর দুই মেয়ের সাবেক শ্বশুর এবং সুপরিচিত নেতা ও বড় ব্যবসায়ী। তার কথা সবাই বিশ্বাস করে নিল। পরিণামে দীর্ঘ তিন মাসব্যাপী দিন-রাতের দাওয়াত বাহ্যতঃ নিষ্ফল হল। বিরোধিতার নয়া কৌশল সমূহ,
১. অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি:
হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেল। তারা দেখল অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। অতএব অপবাদের ধারা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একটি হিসাব মতে রাসূলের বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন-তিনি
– পাগল
– কবি
– জাদুকর ও
– মহা মিথ্যাবাদী
– পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী
– অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী
– মিথ্যা রটনাকারী
– ভবিষ্যদ্বক্তা
– ফেরেশতা নয়, এতো সাধারণ মানুষ
– পথভ্রষ্ট
– বেদ্বীন
– পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী
– জামা‘আত বিভক্তকারী
– জাদুগ্রস্ত
– ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত)
এতদ্ব্যতীত মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহুদীরা রাসূলকে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ شريرنا ‘আমাদের দুষ্ট ব্যক্তিটি’। এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন,
انْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعْوْنَ سَبِيْلاً
‘দেখ ওরা তোমার জন্য কেমন সব উপমা দেয়। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা পথ পেতে পারে না’(বনুইস্রাঈল১৭/৪৮)।
২. নাচ-গানের আসর করা:
অন্যতম কুরায়েশ নেতা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ী নযর বিন হারেছ তৎকালীন সমৃদ্ধ নগরী ইরাকের ‘হীরা’ চলে গেল এবং সেখান থেকে পারস্যের প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কাহিনী, মহাবীর রুস্তম ও খৃষ্টপূর্বকালের দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখে এসে মক্কায় বিভিন্ন স্থানে গল্পের আসর বসাতে শুরু করল।
যেখানেই রাসূল (সাঃ) মানুষকে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা শুনিয়ে মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দিতেন, নযর বিন হারেছ সেখানে গিয়ে উক্ত সব কাহিনী শুনিয়ে বলত, এগুলো কি মুহাম্মাদের কাহিনীর চেয়ে উত্তম নয়? এতেও সে ক্ষান্ত না হয়ে অনেকগুলি সুন্দরী দাসী ক্রয় করল, যারা নাচ-গানে পারদর্শী ছিল।
উপরোক্ত ঘৃণ্য ক্রিয়া-কলাপের প্রেক্ষিতেই নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ-
‘লোকেদের মধ্যে একটি শ্রেণী আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ হ’তে গোমরাহ করার জন্য অলীক কল্পকাহিনী খরিদ করে অজ্ঞতাবশে এবং এগুলো খেল-তামাশা রূপে গ্রহণ করে। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (লোকমান৩১/৬)।
৩. ইহুদী-নাছারা পন্ডিতদের সাহায্য নিয়ে তাঁকে ভন্ডনবী প্রমাণের চেষ্টা:
এতদুদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতারা পরামর্শ করে নযর ইবনে হারেছ এবং ওক্ববা ইবনে আবী মু‘আইত্বকে মদীনায় পাঠায়। সেখানকার ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা তাদেরকে তিনটি প্রস্তাব শিখিয়ে দিয়ে বলল যে, যদি মুহাম্মাদ এগুলির সঠিক জবাব দিতে পারে, তাহলে সে যথার্থ নবী। প্রশ্ন তিনটি ছিল নিম্নরূপ :
– আছহাবে কাহফের সেই যুবকদের ঘটনা, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
– যুল-ক্বারনায়েন-এর ঘটনা, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে বিশ্বব্যাপী সফর করেছিলেন।
– রূহ কি? এগুলির মধ্যে রূহ কি- এ প্রশ্নের জবাবে সূরা বনু ইস্রাঈলের ৮৫ আয়াতে নাযিল হয়। অতঃপর বাকী দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা কাহফ নাযিল হয় (ইবনুজারীরইবনুআববাস (রাঃ) হতেএবংকুরতুবী, ইবনুকাছীর)।
৪. ইহুদী পন্ডিতদের আনিয়ে সরাসরি নবীকে পরীক্ষা করা
৫. চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাব:
কুরায়েশ নেতারা দল বেঁধে রাসূলের কাছে গিয়ে এক চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রিতে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য বলল। কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শন করলেন। মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল।
উভয় টুকরার মাঝখানে পাহাড় আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে সংযুক্ত হল। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে শূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হল
اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ
‘ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’(ক্বামার৫৪/১)।
এতবড় ঘটনা চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও কুরায়েশ নেতারা ঈমান আনলো না। পরে বিভিন্ন এলাকা হতে লোকদের কাছেও তারা একই ঘটনা শুনলো। কিন্তু যিদ ও অহংকার তাদেরকে বিরত রাখলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَإِن يَرَوْا آيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ، وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءهُمْ وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ،
‘তারা যদি কোন নিদর্শন (যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ) দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে যে, এটা তো বড় শক্ত জাদু’। ‘তারা মিথ্যারোপ করল এবং নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করল। অথচ প্রত্যেক কাজই স্থিরীকৃত (ক্বামার২-৩)।
তারীখে ফিরিশতায় বর্ণিত হয়েছে যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণের এই দৃশ্য ভারতের মালাবারের জনৈক মহারাজা স্বচক্ষে দেখেন এবং তা নিজের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে আরব বণিকদের মুখে ঘটনা শুনে তিনি মুসলমান হয়ে যান।
৬. আপোষমুখী দাওয়াতী পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব পেশ:
বুদ্ধিবৃত্তিক ও অলৌকিক সকল পন্থায় পরাজিত হওয়ায় কুরায়েশ নেতারা এবার আপোষমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করল। কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জনের নীতিতে তারা রাসূলের সাথে আপোষ করতে চাইল। কুরআনের ভাষায়
وَدُّوا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُوْنَ
‘তারা চায় যদি আপনি কিছুটা শিথিল হয়ে যান, তাহ’লে তারাও নমনীয় হয়ে যাবে’ (ক্বলম৬৮/৯)।
এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :
(ক) মুহাম্মাদ এক বছর আমাদের মা‘বূদের (অর্থাৎ দেব-দেবীর) পূজা করবে, আমরাও একবছর মুহাম্মাদের রব-এর পূজা করব (ইবনুজারীরওত্বাবারাণী)।
(খ) যদি মুহাম্মাদ আমাদের উপাস্যগুলির স্বীকৃতি দেয়, তাহলে আমরা সকলে তার উপাস্যের ইবাদত করব
(গ) আমরা উভয়ে উভয়ের মা‘বূদের পূজা করব। তারপর দেখব, যার মা‘বূদ যে অংশে উত্তম, আমরা সেই অংশটুকু পরস্পরে গ্রহণ করে নেব
(ঘ) মুহাম্মাদ আমাদের দেব-দেবীর গায়ে কেবল একটু হাত বুলিয়ে দিক, তাতেই আমরা তাকে সত্য বলে মেনে নিব। তখন সূরা কাফেরূণ নাযিল হয় এবং তাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়।
৭. লোভনীয় প্রস্তাব পেশ:
অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ প্রেরণ করল। সেরা ধনী অলীদ বিন মুগীরাহর নেতৃত্বে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত নওমুসলিমদের বলতে লাগলো যে, তোমরা পিতৃধর্মে ফিরে এলে তোমাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন,
قُلْ أَغَيْرَ اللهِ أَبْغِي رَبّاً وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ وَلاَ تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلاَّ عَلَيْهَا وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ثُمَّ إِلَى رَبِّكُم مَّرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ-
‘আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে পালনকর্তা হিসাবে কামনা করব? অথচ তিনিই সকল বস্ত্তর প্রতিপালক। যে ব্যক্তি কোন পাপ করে, সেটা তারই। কেউ কারু বোঝা বহন করবে না। তোমাদের প্রভুর নিকটেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে। অতঃপর তিনিই তোমাদের জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা বিরোধ করতে’ (আন‘আম ৬/১৬৪)।
৮. উদ্ভট দাবী সমূহ পেশ:
যেমন
(ক) কুরায়েশ নেতারা বলল, মুহাম্মাদ তুমি তোমার প্রভুকে বল যেন মক্কার পাহাড়গুলি সরিয়ে এস্থানটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেন
(খ) এখানে নহর সমূহ প্রবাহিত করে দেন, যেমন সিরিয়া ও ইরাকে রয়েছে’
গ) ছাফা পাহাড়কে যেন স্বর্ণের পাহাড় বানিয়ে দেন। [6]
(ঘ) তিনি যেন আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে দেন এবং তার মধ্যে যেন অবশ্যই আমাদের বিশ্বস্ত নেতা ও পূর্বপুরুষ কুছাই বিন কিলাব থাকেন। যিনি এসে বলবেন যে, হাঁ, আল্লাহর কাছে তোমার কিছু মর্যাদা আছে এবং তিনি তোমাকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন।
জবাবে রাসূল প্রেরণের তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ-
‘তিনি সেই মহান সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের মধ্যকার একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের নিকটে তাঁর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করেন ও তাদের (হৃদয় জগতকে) পরিচ্ছন্ন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে ছিল স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে’(জুম‘আ ৬২/২)।
৯. দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের দাবী পেশ:
– এক সময় তারা তিনটি দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়।
– এক- যদি তুমি সত্যই নবী হয়ে থাক, তবে মো‘জেযার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আমাদের কাছে এনে দাও।
– দুই-আমাদের ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের বিষয়গুলি বলে দাও। যাতে আমরা আগেভাগে সাবধান হ’তে পারি।
– তিন-তুমি একজন ফেরেশতাকে নবী হিসাবে এনে দাও, আমরা তাকে নেতা রূপে মেনে নেব। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত একজন মানুষ মাত্র।
জবাবে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
قُل لآ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلاَ تَتَفَكَّرُونَ-
‘আপনি বলে দিন যে, আমি তোমাদেরকে একথা বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার সমূহ রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগত নই। আমি একথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো কেবল অহি-র অনুসরণ করি। যা আমার নিকটে প্রেরণ করা হয়। আপনি বলে দিন যে, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কখনো কি সমান হয়? তোমরা কি চিন্তা করবে না? (আন‘আম৬/৫০)।
১০. বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শন: যেমন-
(ক) তারা যুক্তি দেখিয়ে বলে, আল্লাহ প্রেরিত রাসূল হ’লে সে কখনো মানুষের মত খাওয়া-দাওয়া ও বাজার-ঘাট করে বেড়াত না। আল্লাহ বলেন,
وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَ مْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً-
‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল খাদ্য আহার করে ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করে? কেন তার নিকটে ফেরেশতা নাযিল হ’ল না যে তার সাথে ভয় প্রদর্শনকারী হ’ত’ (ফুরক্বান২৫/৭)।
জবাবে আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكاً لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلاً وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ-
‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত এবং তাকে ঐ ধরনের পোষাক পরাতাম, যা তারা পরিধান করে’ (আন‘আম৬/৯)।
(খ) তারা বলল, যদি নিতান্তই কোন মানুষকে নবী করার ইচ্ছা ছিল, তাহ’লে মক্কা ও ত্বায়েফের বিত্তবান প্রভাবশালী কোন ব্যক্তিকে কেন নবী করা হল না? আল্লাহ বলেন,
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ-
‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপরে অবতীর্ণ হল না? (যুখরুফ৪৩/৩১)।
জবাবে আল্লাহ বলেন,
أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ
‘তারা কি আপনার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করবে? (যুখরুফ৪৩/৩২)।
অর্থাৎ আল্লাহ কাকে নবুঅত দান করবেন এটা কেবল তাঁরই এখতিয়ার। রহমত বণ্টনের দায়িত্ব সম্পর্ণরূপে তাঁর হাতে।
(গ) কোন যুক্তিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা অজুহাত দিল, যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহ’লে আমরা শিরক করতাম না।
যেমন আল্লাহ বলেন,
سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُواْ لَوْ شَاء اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلاَ حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم حَتَّى ذَاقُواْ بَأْسَنَا قُلْ هَل ْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إَلاَّ تَخْرُصُونَ-
‘এখন মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা … আপনি বলুন, তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে যে, আমাদের দেখাতে পার? তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং কেবল অনুমান করে কথা বলে থাক’ (আন‘আম৬/১৪৮)।
অথচ বান্দা শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হউক, এটা কখনোই আল্লাহ চান না। যেমন তিনি বলেন,
وَلاَيَرْضَى لِعَبِادِهِ الْكُفْرَ
‘তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট নন (যুমার৩৯/৭)।