মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শিশু, যুবক ও ব্যবসায়ী সময়
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শিশু, যুবক ও ব্যবসায়ী সময়
ধাত্রীগৃহে মুহাম্মাদ:
সে সময়ে শহরবাসী আরবদের মধ্যে এই প্রথা চালু ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম ও সবল হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে বনু সাদ গোত্রের হালীমা সাদিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন।
বক্ষ বিদারণ:
হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ অন্যান্য সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে অনতিদূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দিলেন এবং বললেন,
هذا حظ الشيطان منك
‘শয়তানের যে অংশ তোমার মধ্যে ছিল, সেটা এই’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছয় বছর।
আমেনার ইয়াছরিব গমন ও মৃত্যুবরণ:
প্রাণাধিক সন্তানকে কাছে পেয়ে আমেনা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কবর যেয়ারত করার মনস্থ করেন। শ্বশুর আব্দুল মুত্ত্বালিব সব ব্যবস্থা করে দেন। সেমতে পুত্র মুহাম্মাদ ও পরিচারিকা উম্মে আয়মনকে নিয়ে তিনি মক্কা হতে ৫০০ কিঃ মিঃ দূরে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর যথাসময়ে মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জাদী পরিবারের গোরস্থানে স্বামীর কবর যেয়ারত করেন। অতঃপর সেখানে এক মাস বিশ্রাম নেন।
এরপর পুনরায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু কিছু দূর এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও ‘আবওয়া’ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসেন। এভাবে জন্ম থেকে পিতৃহারা ইয়াতীম মুহাম্মাদ মাত্র ৬ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে পুনরায় ইয়াতীম হলেন।
দাদার স্নেহনীড়ে মুহাম্মাদ : ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্নেহনীড়ে। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন, তখন তার দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতীজার অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন।
শিশু মুহাম্মাদের কিছু বরকত মন্ডিত নিদর্শন:
(১) হালীমা সা‘দিয়াহ বলেন, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাহন মাদী গাধাটির অবস্থাও ছিল তদ্রুপ। কেননা এই সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষের বছর চলছিল। ফলে বেশী অর্থ পাবে না বলে ইয়াতীম মুহাম্মাদকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। অবশেষে আমি তাকে নিতে সম্মত হ’লাম। অতঃপর যখন তাকে বুকে রাখলাম, তখন সে এবং আমার গর্ভজাত সন্তান দুজনে পেটভরে আমার বুকের দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেল।
ওদিকে উটনীর পালান দুধে ভরে উঠল। যার দুধ আমরা সবাই তৃপ্তির সাথে পান করলাম। তখন আমার স্বামী হারেছ বললেন, হালীমা। আল্লাহর শপথ! তুমি এক মহাভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ। তারপর বাড়ীতে ফিরে আসার সময় দেখা গেল যে, আমাদের সেই দুর্বল মাদী গাধাটি এত তেযী হয়ে গেছে যে, কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল।
(২) বাড়ীতে ফিরে এসে দেখা গেল আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য রাখালরাও সেখানে তাদের পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরত। অথচ আমাদের পশুপাল পরিতৃপ্ত অবস্থায় এবং পালানে দুধভর্তি অবস্থায় বাড়ী ফিরত।
(৩) কা‘বা চত্বরের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বসতেন, সেখানে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে কেউ বসতো না। কিন্তু শিশু মুহাম্মাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এসে সরাসরি দাদার আসনেই বসে পড়তেন। তার চাচারা তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাকে নিজের কাছেই বসাতেন ও গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন, دعوا إبنى هذا فو الله إن له لشأنًا ‘আমার এ বেটাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম এর মধ্যে বিশেষ কিছু শুভ লক্ষণ আছে’।
(৪) দাদার মৃত্যুর পর শিশু মুহাম্মাদ চাচা আবু ত্বালিবের নিকটে লালিত-পালিত হন। আবু ত্বালিব তখন কুরায়েশগণের সরদার। বৃষ্টির অভাবে মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। লোকেরা এসে আবু ত্বালিবকে বলল, চলুন সবাই আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করি। আবু ত্বালিব শিশু মুহাম্মাদকেও সাথে নিলেন এবং কা‘বা গৃহের দেয়াল ঘেঁষে নিজের কাছে দাঁড় করিয়ে পানি প্রার্থনা করলেন।
এমন সময় আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি নেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ভরে উঠলো। তৃষিত মক্কায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে মুগ্ধ-বিস্মিত আবু ত্বালিব ভাতীজার প্রশংসায় বলেন,
وابيض يستقسى الغمام بوجهه * ثمال اليتامى عصمة الأرامل
‘শুভ্র দর্শন (মুহাম্মাদ) যার চেহারার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। সে যে ইয়াতীমদের আশ্রয়স্থল ও বিধবাদের রক্ষক’।
কিশোর মুহাম্মাদ:
১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে সর্বপ্রথম সিরিয়া গমন করেন। সেখানে জারজীস ওরফে বুহায়রা নামক জনৈক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাহেব অর্থাৎ খৃষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি মক্কার কাফেলাকে গভীর আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন এবং কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে কাফেলা নেতা আবু ত্বালেবকে বলেন,
هَذَا سَيِّدُ الْعَالَمِيْنَ هَذَا يَبْعَثُهُ اللهُ رَحْمَةً لِِّلْعَالَمِيْنَ
‘এই বালক হল বিশ্ব জাহানের নেতা একে আল্লাহ বিশ্ব চরাচরের রহমত হিসাবে প্রেরণ করবেন’। অতঃপর চাচা তাকে কিছু গোলামের সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন।
তরুণ মুহাম্মাদ:
তিনি যখন পনের কিংবা বিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন ‘ফিজার যুদ্ধ’ শুরু হয়। এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল কুরায়েশ ও তাদের মিত্র বনু কিনানাহ এবং অপর পক্ষে ছিল ক্বায়েস আয়লান। যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের জয় হয়। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে সম্মানিত মাস (যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ) এবং কা‘বার পবিত্রতা বিনষ্ট হয় বলে একে ‘হারবুল ফিজার’ বা দুষ্টদের যুদ্ধ বলা হয়। তরুণ মুহাম্মাদ এই যুদ্ধে চাচাদের তীর যোগান দেবার কাজে সহায়তা করেন।
‘হিলফুল ফুযূল’ বা ‘কল্যাণকামীদের সংঘ’:
ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে এইরূপ ধ্বংসলীলা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। রাসূল তার চাচা যুরায়ের বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এর সহায়তায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন জাদ‘আন তায়মীর গৃহে বনু হাশেম, বনু মুত্ত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা, বনু তামীম প্রভৃতি গোত্রপ্রধানদের ডেকে বৈঠক করেন।
উক্ত বৈঠকে রাসূলের দাদা ও নানার গোত্র সহ পাঁচটি গোত্র যোগদান করে। তারা হ’ল বনু হাশেম, বনু মুত্ত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা, বনু তামীম। উক্ত বৈঠকে তরুণ মুহাম্মাদ কতগুলি কল্যাণমূলক প্রস্তাব পেশ করেন, যা নেতৃবৃন্দের প্রশংসা অর্জন করে এবং চাচা যোবায়েরের দৃঢ় সমর্থনে বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মূলতঃ ভাতিজা মুহাম্মাদ ছিলেন উক্ত কল্যাণচিন্তার উদ্ভাবক এবং পিতৃব্য যোবায়ের ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান সমর্থক।
আল-আমীন মুহাম্মাদ:
হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার বলে অভিহিত হতে থাকেন। অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত।
যুবক ও ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ:
এখন তিনি পঁচিশ বছরের পরিণত যুবক। কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনই একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা।
মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের চেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্যবসায়ের প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাযী হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন। ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এতবেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।
বিবাহ:
ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ- এর নিকটে। তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দুমাসের মাথায় সমাজ নেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এই সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে তিনি ‘তাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।
সন্তান-সন্ততি:
পঁচিশ বছর তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়। ইবরাহীম ব্যতীত রাসূলের সকল সন্তান ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। খাদীজার গর্ভে রাসূলের প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলের উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, রুক্বাইয়া, উম্মে কুলছূম, ফাতেমা সবশেষে পুত্র আব্দুল্লাহ, যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের। রাসূলের সকল পুত্র সন্তান শৈশবেই মারা যান।
কন্যাগণ সবাই বিবাহিত হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত সবাই রাসূলের জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলের মৃত্যুর ছয় মাস পরে ফাতেমা মৃত্যু বরণ করেন। রাসূলের অন্য পুত্র ‘ইবরাহীম’ ছিলেন অন্য স্ত্রী মারিয়া ক্বিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদীনায় সর্বশেষ সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই ১০ম হিজরীর ২৯ শাওয়াল সোমবার মাত্র ১৮ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন।
কা‘বা গৃহ পুনর্নির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা:
আল-আমীন মুহাম্মাদ-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কা‘বা অর্থই হ’ল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা‘বা পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।
অতঃপর কা‘বা গৃহ পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, কারু কোনরূপ হারাম মাল এর নির্মাণ কাজে লাগানো যাবে না। কোন্ কোন্ গোত্র কোন্ পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তারপর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে ‘বাকুম’ (باقوم بنّاء رومى) নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকার্য শুরু হয়।
কিন্তু গোল বাঁধে দক্ষিণ- পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন্ গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তারক্তিতে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। এই সময় প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারাম’ শরীফে প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।
আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় আল-আমীন। তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো-
هذا محمد هذا الأمين قد رضينابه
‘এযে মুহাম্মাদ, এযে আল-আমীন, আমরা সবাই তার উপরে সন্তুষ্ট’। তিনি ঘটনা শুনে সহজেই মীমাংসা করে দিলেন। তিনি একটা চাদর চাইলেন। অতঃপর সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’-টি তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরুন অতঃপর উঠিয়ে নিয়ে চলুন। তাই করা হল। কা‘বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারিফ করতে করতে চলে গেল।