রোজা সম্পর্কে আলোচনা |কোরআন ও হাদিসের আলোকে রোজা রাখার ইতিহাস
রােজা ‘ শব্দটি ফার্সি । এর আরবি শব্দ হল ‘ সাওম ‘ । ‘ সাওম ‘ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা । শরীয়াতের পরিভাষায় সুহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়াত সহকারে পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকাকে সাওম ‘ বা রােজা বলা হয় । ( আলমগীরী ও কাওয়াইদুল ফিহ )
ইসলামের দৃষ্টিতে রােযা হল এমন এক সার্বজনীন ইবাদত যা রােজাদারকে দান করে আত্মার সজীবতা , হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা । এ রােযার উপর আল্লাহ্ তা ‘ আলা যে পুরস্কার ঘােষণা করেছেন তা এক মুহুর্তে মানুষকে করে তােলে ভােগে বিতৃষ্ণ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান ।
হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ রয়েছে । আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেনঃ রােযা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দান করবাে ।
অন্য এক হাদিসে আছে রােজাদার ব্যক্তি দু ‘ টি আনন্দ লাভ করবে, একটি আনন্দ হল ইফতারের মুহুর্তে আর অপরটি হলাে তাঁর প্রতি পালকে সাথে সাক্ষাতের মুহুর্তে রােজাদার ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কষ্ট না হয় এর জন্য রাসূলুল্লাহ ( সঃ ) সাহরীকে সুন্নাত এবং বিলম্বে সাহরী গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন । এমনিভাবে ইফতারের সময় বিলম্ব না করে ওয়াক্ত হতেই ইফতার করার হুকুম দিয়েছেন ।
রোজার ইতিহাস
রােজার ইতিহাস বস্তুত রােজা রাখার বিধাণ সর্বযুগে ছিল । হযরত আদম ( আঃ ) থেকে শুরু করে আখিরী নবী হযরত মুহাম্মাদ ( সঃ ) পর্যন্ত সকল নবী – রাসূলগণের যুগেই রােজার বিধান ছিল । এদিকে ইঙ্গিত করে আল – কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ হে ইমানদারগণ তােমাদের উপর রােজা ফরজ করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে তােমরা তাকওয়া অবলম্বন কর । (সূরা বাকারা ,আয়াত ১৮৩)
এ আয়তের ব্যাখ্যায় আল্লামা আব্দুসী ( রঃ ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থ ‘ রুহুল মাআনী ‘ তে উল্লেখ করেছেন যে এখানে ‘ মিন কাবলিকুম ‘ দ্বারা হযরত আদম ( আঃ ) হতে শুরু করে হযরত ঈসা ( আঃ ) এর যুগ পর্যন্ত সকল যুগের মানুষকে বুঝানাে হয়েছে । এতে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে , রােযা কেবল আমাদের উপরই ফরয করা হয়নি বরং আদম ( আঃ ) এর যুগ হতেই চলে এসেছে । অন্যান্য তাফসীর বিশারদগণও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন । শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ( রঃ ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ রােযার হুকুম হযরত আদম ( আঃ ) এর যুগ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে। – ফাওয়াইদে উসমানী।
তবে হযরত আদম ( আঃ ) এর রােযার ধরন কেমন ছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না । আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন কাশীর ( রঃ ) বলেন , ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রতি মাসে তিন দিন রােযা রাখার বিধান ছিল । পরে রমজানের রােযা ফরয হলে তা রহিত হয়ে যায় । হযরত মু ‘ আয ইবন মাসউদ , ইবন আব্বাস , আতা , কাতাদা এবং যাহ্হাক ( রাঃ ) এর মতে তিন দিন রােযা রাখার বিধান হযরত নূহ ( আঃ ) এর যুগ হতে শুরু করে নবী করিম ( সঃ ) এর জামানা পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
পরে আল্লাহ্ তা’আলা রামাযানের রােযা ফরজ করে ঐ বিধান রহিত করে দেন । তাফসীরে রুহুল মা ‘ আনীতে এ কথাও উল্লেখ রয়েছে যে,যেমন বিধান তােমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল বলে যে তুলনা করা হয়েছে তা শুধু ফরয হওয়ার ব্যাপারে প্রযােজ্য হতে পারে । অর্থাৎ তােমাদের উপর যেমন রােযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তােমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রােযা ফরজ করা হয়েছিল । যদিও নিয়ম এবং সময়ের দিক থেকেও এ তুলনা প্রযােজ্য হতে পারে । তাই বলা হয় যে,কিতাবিদের উপরও রামাযানের রােযা ফরজ ছিল।
তারা তা বর্জন করে বছরে ঐ একদিন উপবাসব্রত পালন করে , যেদিন ফির ‘আউন নীলনদে নিমজ্জিত হয়েছিল । এরপর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও উক্ত দিনে রােজা রাখে । অবশ্য তারা এর সাথে আগে – পিছে আরাে দুইদিন সংযােজন করে নেয় । এভাবে বাড়াতে বাড়াতে তারা রােজার সংখ্যা পঞ্চাশের কোটায় পৌঁছে দেয় । গরমের দিন এ রােজা তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হলে তারা তা পরিবর্তন করে শীতের মৌসুমে নিয়ে আসে ।
মুগাফ্ফাল ইবনে হানযালা ( রাঃ ) থেকে বর্নিত । রাসূলুল্লাহ ( সঃ ) ইরশাদ করেন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপর রমজানের একমাস রােযা ফরয করা হয়েছিল । পরবর্তীকালে তাঁদের জনৈক বাদশাহ অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা এ মর্মে মানত করে যে , আল্লাহ্ তাঁকে রােগমুক্ত করলে রােযার মেয়াদ আরাে দশ দিন বাড়িয়ে দেব । এরপর পরবর্তী বাদশাহর আমলে গােস্ত খাওয়ার কারনে বাদশাহর মুখে রােগব্যধি দেখা দিলে তারা আবারাে মানত করে যে , আল্লাহ্ যদি তাঁকে সুস্থ করে দেন তবে আমরা অতিরিক্ত আরাে সাতদিন রােযা রাখব । তারপর আরেক বাদশাহ সিংহাসনে সমাসীন হয়ে তিনি বললেন , তিন দিন আর ছাড়বাে কেন ? এবং তিনি এও বলেন যে , এ রােযাগুলাে আমরা বসন্তকালে পালন করব ।এভাবে রােযা ত্রিশের সংখ্যা অতিক্রম করে পঞ্চাশের কোটায় পৌঁছে যায় – রুহুল মাআনি , ২য় খন্ড।
হযরত ইবন আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্নিত , তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ ( সঃ ) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে , ইয়াহুদীরা আশুরার দিন সাওম পালন করে । তিনি জিজ্ঞাসা করালেন কি ব্যাপার ? ( তােমরা এ দিনে সাওম পালন কর কেন ? ) তারা বলল , এ অতি উত্তম দিন । এ দিনে আল্লাহ্ তা ‘ আলা বনী ইসরাইলকে তাঁদের শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেন , ফলে এ দিনে মুসা ( আঃ ) সাওম পালন করেন । রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন আমি তােমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক হকদার । এরপর তিনি এ দিন পালন করেন এবং সাওম পালনের নির্দেশ দেন ।বুখারী , সাওম অধ্যায় ।
আরো পড়ুনঃ রমজান মাসের ফজিলত ও সেহরি ও ইফতারের দোয়া
উপরােক্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে , হযরত মুসা ও হযরত ঈসা ( আঃ ) এবং তাঁদের উম্মতগণ সকলেই সাওম পালন করেছেন । নবীগণের মধ্যে হযরত দাউদ ( আঃ ) এর রােযা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য । হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস ( রাঃ ) থেকে বর্নিত তিনি বলেন , নবী ( সঃ ) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কি সবসময় রােযা রাখ এবং রাতভর নামায আদায় কর। আমি বললাম জী , হ্যাঁ । তিনি বললেনঃ তুমি এরূপ করলে তােমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দূর্বল হয়ে পড়বে । যে ব্যক্তি সারা বছর রােযা রাখল সে যেন রােযাই রাখল না। ( প্রতি মাসে ) তিনি দিন রােযা রাখা সারা বছর রােযা রাখার সমতুল্য । আমি বললাম , আমি এর চেয়ে বেশী রাখার সামর্থ রাখি । তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি সাওমে দাঊদী ’ পালন কর । তিনি একদিন রােযা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন । ( ফলে তিনি দূর্বল হতেন না ) এবং যখন তিনি শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না । – বুখারী , সাওম অধ্যায়।
এতে একথা প্রমাণিত হয় যে , হযরত দাউদ ( আঃ ) ও সিয়াম পালন করেছেন । মােটকথা হযরত আদম (আঃ) এর যুগ থেকেই রােযা রাখার বিধান ছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে আদর্শচ্যুত হয়ে লােকেরা আল্লাহর বিভিন্ন বিধানকে যেভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল অনুরূপভাবে রােযার ধর্মীয় তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য শেষ হয়ে একটি নিছক প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল । এহেন অবস্থা হতে রােযাকে রহমত , বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং একে অত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানাের নিমিত্তে মহান রাব্বল আলামিন দ্বিতীয় হিজরিতে রামাযানের মাসের রােযাকে উম্মাতের পর ফরয করে দেন ।
প্রশ্নঃ রোজা ফরজ হয় কত হিজরিতে ?
উত্তরঃ ২য় হিজরিতে রোজা ফরজ হয়।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ
আরও ইরশাদ হয়েছেঃشَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ وَ مَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَ لَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَ لِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَ لِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۱۸۵﴾
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে
মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। শুরা বাকারা , আয়াত ১৮৫
ইসলাম অন্যানায় ইবাদতের মত রােযার মধ্যেও বেশ কিছু মৌলিক ও বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেছে।সমাজের সর্বস্তরে এ সুদূরপ্রসারী সংস্কারের প্রভাব সুস্পষ্ট । ইসলামের সর্বপ্রধান সংস্কার হল রােযার ব্যাপারে ধারনাগত পরিবর্তন । অর্থাৎ ইয়াহুদীদের দৃষ্টিতে রােযা ছিল বেদনা ও শােকের প্রতীক । ইসলাম এই হতাশাব্যঞ্জক ভ্রান্ত ধারনাকে স্বীকার করেনি । কোন কোন প্রাচীন ধর্ম মতে রােযা এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য পালনীয় ছিল । কিন্তু ইসলাম রােযাকে সকল শ্রেণী বিভক্তি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক সার্বজনীন রূপ দান করেছে । ইসলামের বিধানে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রােযা রাখা ফরজ ।