মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
হোদায়বিয়ার সন্ধি ও ঘটনা
হোদায়বিয়ার সন্ধি ও ঘটনা
(৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এক রাতে স্বপ্ন দেখানো হল যে, তিনি স্বীয় ছাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেছেন এবং ওমরাহ করেছেন। কেউ মাথার চুল ছেটেছে কেউ মুন্ডন করেছে (ফাৎহ ৪৮/২৭)। এ স্বপ্ন দেখার পরে তিনি ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ছাহাবীগণকে প্রস্ত্তত হতে বলেন। ইতিপূর্বে খন্দক যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সমগ্র আরবে মুসলিম শক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করা হতে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিছুটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন।
মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা :
অতঃপর ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার তিনি ১৪০০ (অথবা ১৫০০) সাথী নিয়ে মদীনা হতে রওয়ানা হন। লটারিতে এবার তাঁর সফরসঙ্গী হন উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ)। সফর অবস্থার নিয়মানুযায়ী কোষবদ্ধ তরবারি এবং মুসাফিরের হালকা অস্ত্র ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র তাঁদের নিকটে রইল না। অতঃপর মদীনার অনতিদূরে যুল-হুলায়ফা পৌঁছে তাঁরা নিয়মানুযায়ী স্ব স্ব কুরবানীর পশুর গলায় হার পরালেন এবং উটের পিঠের কুঁজের উপরে সামান্য কেটে রক্তপাত করে কুরবানীর জন্য চিহ্নিত করলেন।
এরপর ওমরাহর জন্য এহরাম বেঁধে রওয়ানা হলেন। মুসলমানদের মিত্র খোযা‘আ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসাবে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আগেই পাঠিয়েছিলেন মক্কায় কুরায়েশদের গতিবিধি জানার জন্য। রাসূল (সাঃ) ‘আসফান’ পৌঁছলে উক্ত গোয়েন্দা এসে খবর দেয় যে, কুরায়েশরা ওমরাহতে বাধা দেওয়ার জন্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে।
খালিদের অপকৌশল:
কিছুদূর অগ্রসর হতেই জানা গেল যে, মক্কার মহা সড়কে ‘কোরাউল গামীম’নামক স্থানে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ ২০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে প্রস্ত্তত হয়ে আছে মুসলিম কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য। যেখান থেকে উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে খালেদ মুসলমানদের যোহরের ছালাত আদায়ের দৃশ্য অবলোকন করে বুঝতে পারেন যে, মুসলমানেরা ছালাত আদায় কালে দুনিয়া ভুলে যায় ও আখেরাতের চিন্তায় বিভোর হয়ে যায়।
শয়তান তার মনে কু-মন্ত্রণা দিল যে, আছরের ছালাত আদায় কালেই তিনি মুসলিম কাফেলার উপরে ক্ষিপ্রগতিতে হামলা চালিয়ে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আল্লাহ পাক তাদের এ চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেবার জন্য তার রাসূলের উপরে এ সময় ছালাতুল খাওফের বিধান নাযিল করলেন (নিসা ৪/১০১-১০২)। ফলে আছরের ছালাতের সময় একদল যখন ছালাত আদায় করলেন, অন্যদল তখন সতর্ক পাহারায় রইলেন।
হোদায়বিয়ায় অবতরণ ও পানির সংকট:
শান্তিপ্রিয় রাসূল (সাঃ) যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মহাসড়ক ছেড়ে ডান দিকে আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকেন এবং মক্কার নিম্নাঞ্চল হোদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে একটি ঝর্ণার নিকটে গিয়ে অবতরণ করলেন। ছহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর উষ্ট্রী ‘ক্বাছওয়া’ বসে পড়ে। লোকেরা বলল, ক্বাছওয়া নাখোশ হয়েছে । রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘ক্বাছওয়া নাখোশ হয়নি, আর এটা তার চরিত্রে নেই। কিন্তু তাকে আটকে দিয়েছেন সেই সত্তা যিনি (আবরাহার) হস্তীকে (কা‘বায় হামলা করা থেকে) আটকিয়েছিলেন’। [1]
তৃষ্ণার্ত সাথীদের পানির সমস্যা সমাধানে উক্ত ঝর্ণা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে গেল। তখন সবাই রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পানির আবেদন করল। রাসূল (সাঃ) নিজের শরাধার থেকে একটি তীর বের করে তাদের হাতে দিলেন এবং সেটাকে ঝর্ণায় নিক্ষেপ করার জন্য বললেন। ‘অতঃপর আল্লাহর কসম! ঝর্ণায় অতক্ষণ পর্যন্ত পানি জোশ মারতে থাকল, যতক্ষণ না তারা পরিতৃপ্ত হলেন এবং সেখান থেকে (মদীনায়) ফিরে গেলেন’। বস্তুত এটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর অন্যতম মু‘জেযা।
মধ্যস্থতা বৈঠক:
হোদায়বিয়ায় অবতরণের কিছু পরে মুসলমানদের হিতাকাংখী বনু খোয়া‘আহর নেতা বুদাইল বিন অরক্বা কিছু লোক সহ উপস্থিত হলেন। তিনি এসে খবর দিলেন যে, কুরায়েশ নেতা কা‘ব বিন লুওয়াই সৈন্য-সামন্ত এমনকি নারী-শিশু নিয়ে হোদায়বিয়ার পর্যাপ্ত পানিপূর্ণ ঝর্ণার ধারে শিবির স্থাপন করেছে, আপনাদের বাধা দেওয়ার জন্য ও প্রয়োজনে যুদ্ধ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে গিয়ে বল যে, আমরা এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি। স্রেফ ওমরাহ করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
কুরায়েশরা ইতিপূর্বে যুদ্ধ করেছে এবং তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। তারা চাইলে আমি তাদের জন্য একটা সময় বেঁধে দেব, সে সময়ে তারা সরে দাঁড়াবে (এবং আমরা ওমরাহ করে নেব)। এরপরেও তারা যদি না মানে এবং কেবল যুদ্ধই তাদের কাম্য হয়,’ তাহলে যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে এই দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আমার আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় অথবা আল্লাহ স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফায়ছালা করে দেন’।
এ সময় সেখানে উপস্থিত উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী বলে উঠলো, এই লোকটি (মুহাম্মাদ) তোমাদের নিকটে একটা ভাল প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তোমরা সেটা কবুল করে নাও এবং আমাকে একবার তার কাছে যেতে দাও’। অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে সে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হল। রাসূল (সাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা তিনি ইতিপূর্বে বুদাইলকে বলেছিলেন। জবাবে উরওয়া বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি নিজ সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দাও, তবে ইতিপূর্বে কোন আরব এরূপ করেনি।
আর যদি বিপরীতটা হয়, (অর্থাৎ তুমি পরাজিত হও) তবে আল্লাহর কসম! তোমার পাশে এমন কিছু নিকৃষ্ট লোককে দেখছি, যারা তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে’। তার এ মন্তব্য শুনে ঠান্ডা মেযাজের আবুবকর (রাঃ) রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, ‘লাতের লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চর্ম লেহন করতে থাক। আমরা রাসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাব’?
আলোচনা শেষে উরওয়া কুরায়েশদের নিকটে ফিরে গিয়ে খবর দিল‘হে আমার কওম! আল্লাহর কসম! আমি কিসরা, কায়ছার ও নাজ্জাশী প্রমুখ সম্রাটদের দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু কোন সম্রাট-এর প্রতি তার সহচরদের এমন সম্মান করতে দেখিনি, যেমনটি দেখেছি মুহাম্মাদের প্রতি তার সাথীদের সম্মান করতে’। অতঃপর তিনি রাসূলের ছাহাবীদের সম্মান প্রদর্শনের এবং ভক্তি শ্রদ্ধার কতগুলি উদাহরণ পেশ করে বলেন, আল্লাহর কসম! তারা তাঁর থুথু হাতে ধরে মুখে ও গায়ে মেখে নেয়।
তার ওযূর ব্যবহৃত পানি ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে। তার নির্দেশ পালনের জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তাঁর কথা বলার সময় সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যায়, অধিক সম্মানের কারণে কেউ তাঁর প্রতি পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করে না’। অতএব যে প্রস্তাব তিনি তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন, তোমরা তা কবুল করে নাও’।
ওছমানকে মক্কায় প্রেরণ:
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরায়েশদের নিকটে এমন একজন দূত প্রেরণের চিন্তা করলেন, যিনি তাদের নিকটে গিয়ে বর্তমান সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন এবং অহেতুক যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ওছমানকে ডাকলেন এবং তাকে কুরায়েশ নেতাদের কাছে পাঠালেন এই বলে যে, ‘আমরা লড়াই করতে আসিনি বরং আমরা এসেছি ওমরাহকারী হিসাবে’।
তিনি তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতে বললেন। এছাড়াও মক্কার লুক্কায়িত মুমিন নর-নারীদের কাছে সত্বর বিজয়ের সুসংবাদ শুনাতে বললেন এবং বলতে বললেন যে, আল্লাহ শীঘ্র তাঁর দ্বীনকে মক্কায় বিজয়ী করবেন। তখন আর কাউকে তার ঈমান লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন হবে না’।
আদেশ পাওয়ার পর হযরত ওছমান (রাঃ) মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। বালদাহ (بلدح) নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশদের কিছু লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে অমুক অমুক কাজে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, قد سمعنا ما تقول ‘আমরা শুনেছি আপনি যা বলবেন’। এমন সময় আবান ইবনু সাঈদ ইবনুল আছ এসে তাঁকে খোশ আমদেদ জানিয়ে নিজ ঘোড়ায় তাকে বসিয়ে নিলেন।
অতঃপর মক্কায় উপস্থিত হয়ে ওছমান (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক নেতৃবৃন্দের নিকটে বার্তা পৌঁছে দিলেন ও তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বার্তা পৌঁছানোর কাজ শেষ হলে নেতারা তাঁকে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বে তিনি তাওয়াফ করতে অস্বীকার করলেন।
ওছমান হত্যার গুজব ও বায়‘আতে রেযওয়ান:
ওছমান (রাঃ) প্রদত্ত প্রস্তাবনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাব প্রদানের জন্য কুরায়েশ নেতাদের শলা-পরামর্শ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। এতে তাঁর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হয়। ফলে মুসলিম শিবিরে তাঁর হত্যার গুজব রটে যায়। সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে উঠলেন, ‘বদলা না নেয়া পর্যন্ত আমরা স্থান ত্যাগ করব না’। অতঃপর তিনি সবাইকে বায়‘আতের জন্য আহবান জানালেন।
তখন সবাই ঝাঁপিয়ে এসে বায়‘আত করল এই মর্মে যে, তারা কখনোই পালিয়ে যাবে না। একদল মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করল। এ ঘটনাই বায়‘আতুর রিযওয়ান বা সন্তুষ্টির বায়‘আত নামে খ্যাত। কেননা আল্লাহ পাক মুসলমানদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বায়‘আত গ্রহণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সাথে সাথে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেছিলেন-
لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيْباً-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছন মুমিনদের উপরে যখন তারা বায়‘আত করছিল তোমার নিকটে বৃক্ষের নীচে। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের উপরে বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন’ (ফাৎহ ৪৮/১৮)।
হোদায়বিয়ার সন্ধি ও তার দফা সমূহ:
অতঃপর কুরায়েশদের পক্ষ হতে সোহায়েল বিন আমরকে প্রেরণ করা হল। প্রেরণের সময় তাকে জোরালোভাবে একথা বলে দেওয়া হয় যে, সন্ধি চুক্তির পূর্বশর্ত এটাই হবে যে, তাদেরকে এবছর ওমরাহ না করেই ফিরে যেতে হবে। যাতে আরবরা একথা বলার সুযোগ না পায় যে, মুসলমানেরা আমাদের উপরে যবরদস্তি প্রবেশ করেছে। দূর থেকে সোহায়েলকে আসতে দেখে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মন্তব্য করেন যে, ‘তোমাদের জন্য কাজ সহজ করা হয়েছে। কুরায়েশরা সন্ধি চায় বলেই এ লোকটিকে পাঠিয়েছে’। অতঃপর সুহায়েল এসে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর উভয় পক্ষ নিম্নোক্ত দফাসমূহে একমত হয়।
১। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় ফিরে যাবেন। আগামী বছর ওমরাহ করবেন এবং মক্কায় তিনদিন অবস্থান করবেন। সঙ্গে সফরের প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে এবং তরবারি কোষবদ্ধ থাকবে। কুরায়েশগণ তাদের কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।
২। দু’পক্ষের মধ্যে আগামী ১০ বছর যাবৎ যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই সময় লোকেরা নিরাপদ থাকবে। কেউ কারু উপরে হস্তক্ষেপ করবে না।
৩। যারা মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তার দলে এবং যারা কুরায়েশ-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলে গণ্য হবে। তাদেরকে উক্ত দুই দলের অংশ বলে গণ্য করা হবে। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট সকল দলের উপরে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
৪। কুরায়েশদের কোন লোক পালিয়ে মুহাম্মাদের দলে যোগ দিলে তাকে ফেরৎ দিতে হবে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কেউ কুরায়েশের নিকটে গেলে তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে না।
উপরোক্ত দফাগুলিতে একমত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হযরত আলীকে ডাকলেন। অতঃপর তাকে লিখবার নির্দেশ দিয়ে বললেন, লিখ- ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’। সুহায়েল বলল, ‘রহমান’ কি আমরা জানি না। বরং লেখ- ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলীকে তাই-ই লিখতে বললেন। অতঃপর লিখতে বললেন- ‘এগুলি হল সেইসব বিষয় যার উপরে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করেছেন’।
সোহায়েল বাধা দিয়ে বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে আমরা আপনাকে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখতাম না এবং আপনার সঙ্গে যুদ্ধও করতাম না’। অতএব লিখুন ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন,‘আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল। যতই তোমরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত কর না কেন’?
অতঃপর তিনি আলীকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ মুছে ‘মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ’ লিখতে বললেন। ‘কিন্তু আলী ওটা মুছতে অস্বীকার করলেন’। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে ওটা মুছে দিলেন। তারপর চুক্তিনামা লিখন সম্পন্ন হল। চুক্তি সম্পাদনের পর বনু খোযা‘আহ রাসূলের সাথে এবং বনু বকর কুরায়েশদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হল। অবশ্য বনু খোযা‘আহ আব্দুল মুত্ত্বালিবের সময় থেকেই বনু হাশেমের মিত্র ছিল, যা বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল।
আবু জান্দালের আগমনে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা:
সন্ধিপত্র লেখার কাজ চলছে এরি মধ্যে সুহায়েলপুত্র আবু জান্দাল শিকল পরা অবস্থায় পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে উপস্থিত হয়েই মুসলিম শিবিরে ঢুকে পড়ল। তাকে দেখে সোহায়েল বলে উঠলেন, এই আবু জান্দালই হল প্রথম ব্যক্তি যে বিষয়ে আমরা চুক্তি করেছি যে, আপনি তাকে ফেরৎ দিবেন। (কেননা সে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে আপনার দলে এসেছে)। রাসূল (সাঃ) বললেন, এখনও তো চুক্তি লিখন কাজ শেষ হয়নি? সোহায়েল বলল, আল্লাহর কসম! তাহলে চুক্তির ব্যাপারে আমি আর কোন কথাই বলব না’।
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, অন্ততঃ আমার খাতিরে তুমি তাকে ছেড়ে দাও’। সুহায়েল বলল, আপনার খাতিরেও আমি তাকে ছাড়ব না। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘হাঁ এটুকু তোমাকে করতেই হবে’। সে বলল, ‘না আমি তা করব না’। অতঃপর সোহায়েল আবু জান্দালের মুখে চপেটাঘাত করে তার গলার কাপড় ধরে টানতে টানতে মুশরিকদের নিকটে নিয়ে চলল। আবু জান্দাল তখন অসহায়ভাবে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল ‘হে মুসলিমগণ! আমি কি মুশরিকদের কাছে ফিরে যাব? ওরা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে ফিৎনায় নিক্ষেপ করবে’।
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘হে আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর এবং ছওয়াবের আশা কর। আল্লাহ তোমার ও তোমার সাথী দুর্বলদের জন্য মুক্তির পথ ও প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করে দেবেন। আমরা কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধি করেছি। তারা ও আমরা পরস্পরে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। যা আমরা ভঙ্গ করতে পারি না’।
ওমরাহ হতে হালাল হলেন সবাই:
চুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে হালাল হওয়ার জন্য স্ব স্ব পশু কুরবানী করতে বললেন। তিনি পরপর তিনবার একথা বললেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন রাসূল (সাঃ) উম্মে সালামাহর কাছে গিয়ে বিষয়টি বললেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এটা চাইলে ‘সোজা বেরিয়ে যান ও কাউকে কিছু না বলে নিজের উট নহর করুন।
অতঃপর নাপিত ডেকে নিয়ে নিজের মাথা মুন্ডন করুন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাই করলেন। তখন সবাই উঠে দাঁড়ালো ও স্ব স্ব কুরবানী সম্পন্ন করল। অতঃপর কেউ মাথা মুন্ডন করল, কেউ চুল ছাটলো। সবাই এত দুঃখিত ছিল যে, যেন পরস্পরকে হত্যা করবে।
ফুটনোট:
[1] বুখারী, মিশকাত হা/৪০৪২ ‘জহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘সন্ধি’ অনুচ্ছেদ-৯; ইবনু কাছীর হাদীছটি সূরা ফাৎহ ২৬ আয়াত ও সূরা ফীল-এর তাফসীরে উদ্ধৃত করেছেন।