মহানবী (সাঃ) এর জীবনী

খায়বর যুদ্ধ

খায়বর যুদ্ধ
(৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
রওয়ানা:
হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষে মদীনায় ফিরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পূরা যিলহাজ্জ ও মুহাররম মাসের অর্ধাংশ এখানে অবস্থান করেন। অতঃপর মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহুদী- এগুলির মধ্যে প্রধান কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাকী রইল ইহুদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে ৬০ বা ৮০ মাইল উত্তরে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু।
যুদ্ধ শুরু ও নায়েম দুর্গ জয়:
রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘কাল আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’। [5]
সকালে সবাই রাসূলের দরবারে হাযির হলেন। প্রত্যেকের ধারণা পতাকা তার হাতে আসবে। এমন সময় রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘আলী কোথায়’? সবাই বলল, চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তার কাছে লোক পাঠাও’। অতঃপর তাকে আনা হল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ মুখের লালা তার চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য সুস্থতার দো‘আ করলেন। ফলে তিনি এমনভাবে সুস্থ হলেন যেন ইতিপূর্বে তার চোখে কোন অসুখ ছিল না।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) তার হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, ‘ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাও ও তাদের মুখোমুখি অবস্থান নাও’। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দাও এবং জানিয়ে দাও আল্লাহর হক হিসাবে তাদের উপরে কি কি বিষয় ওয়াজিব রয়েছে। ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ পাক তোমার দ্বারা একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের চাইতে উত্তম হবে’। [6]
অতঃপর হযরত আলী সেনাদল নিয়ে খায়বরের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মযবুত বলে খ্যাত ‘নায়েম’দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হলেন ও তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ইহুদীরা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের নেতা মারহাব দর্পভরে কবিতা বলে এগিয়ে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালো। বীরকেশরী মারহাবকে এক হাযার যোদ্ধার সমকক্ষ মনে করা হত। মারহাবের দর্পিত আহবানে সাড়া দিয়ে পাল্টা কবিতা বলে আমের ইবনুল আকওয়া‘ ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
কিন্তু তাঁর তরবারি আকারে ছোট থাকায় তার আঘাত মারহাবের পায়ের গোছায় না লেগে উল্টা নিজের হাঁটুতে এসে লাগে। যাতে তিনি আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের আঘাতে মৃত্যু হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন যে, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবেন।[7]
এরপর মারহাব পুনরায় গর্বভরে কবিতা আওড়াতে থাকে ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানাতে থাকে। তখন প্রধান সেনাপতি আলী (রাঃ) তার দর্প চূর্ণ করার জন্য নিজেই এগিয়ে গেলেন এবং গর্বভরে কবিতা বলে সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিলেন। এভাবে তাঁর হাতেই মূলতঃ ‘নায়েম’ দুর্গ জয় হয়ে গেল।
অন্যান্য দুর্গ জয়:
নায়েম দুর্গ জয়ের পর দ্বিতীয় প্রধান দুর্গ ছা‘ব বিন মু‘আয দুর্গটি বিজিত হয় হযরত হুবাব বিন মুনযির আনছারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে তিনদিন অবরোধের পর। এই দুর্গটি ছিল খাদ্য সম্ভারে পূর্ণ। আর এই সময় মুসলিম সেনাদলে দারুণ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন এই দুর্গটি জয়ের জন্য আল্লাহর নিকটে রাসূল (সাঃ) বিশেষ দো‘আ করেন এবং সেদিনই সন্ধ্যার পূর্বে দুর্গ জয় সম্পন্ন হয়। এই সময় ক্ষুধার তাড়নায় মুসলিম সেনাদলের কেউ কেউ গাধা যবহ করে তার গোশত রান্না শুরু করে দেয়।
এ খবর রাসূলের কর্ণগোচর হলে তিনি গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন। এই দুর্গ থেকে সেই আমলের প্রচলিত কিছু ট্যাংক ও কামান (মিনজানীক্ব ও দাববাবাহ) হস্তগত হয়। পরে তাদের উপরে কামানের গোলা নিক্ষেপের হুমকি দিলে ১৪ দিন পর তারা বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধির প্রস্তাব দেয়। অতঃপর সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে ‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের তিনটি দুর্গ বিজিত হয়। এভাবে খায়বর বিজয় সম্পন্ন হয়।
সন্ধির আলোচনা:
‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘ক্বামূছ’ দুর্গের অধিপতি মদীনা হতে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা আবুল হুক্বাইক্ব-এর দুই ছেলে সন্ধির বিষয়ে আলোচনার জন্য রাসূলের নিকটে আসেন। আলোচনায় স্থির হয় যে, দুর্গের মধ্যে যারা আছে, তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। তাদের সোনা-রূপাসহ অন্যান্য সকল সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হবে। ইহুদীরা সপরিবারে দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবে। সুনানে আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে যে, নিজ নিজ বাহনের উপরে যতটুকু মাল-সম্পদ নেওয়া সম্ভব ততটুক নেওয়ার অনুমতি তাদের দেওয়া হয়। [10]
ছাফিয়াহর সাথে রাসূলের বিবাহ:
কেনানাহ বিন আবুল হুকাইকের নব বিবাহিতা স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব বন্দী হন। দাসী হিসাবে প্রথমে তাকে দেহিইয়া কালবীকে দেয়া হয়। পরক্ষণেই নেতৃকন্যা হিসাবে তাকে রাসূলের ভাগে দেওয়া হয়। রাসূল (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর তাকে মুক্ত করে তিনি তাকে বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন।
এই মুক্তি দানকেই তার মোহরানা হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর মদীনায় ফেরার পথে ‘ছাহবা’ (الصهباء) নামক স্থানে পৌঁছে ‘ছাফিয়া’ হালাল হলে তার সঙ্গে সেখানে তিনদিন বাসর যাপন করেন। [11]
রাসূলকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা:
খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (সাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হলেন, তখন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর ভূনা রান হাদিয়া পাঠায়। সে আগেই জেনে নিয়েছিল যে, রাসূল (সাঃ) রানের গোশত পসন্দ করেন। এজন্য উক্ত মহিলা উক্ত রানে ভালভাবে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি। অতঃপর বলেন, ‘এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষ মিশ্রিত’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন উক্ত মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলে, এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন,তাহলে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে’। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু সাথী বিশর ইবনুল বারা বিন মা‘রূর এক গ্রাস চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যাতে তিনি মারা যান। ফলে তার বদলা স্বরূপ ঐ মহিলাকে হত্যা করা হয়। [13]
খায়বরের ভূমি ইহুদীদের হাতে প্রত্যর্পণ ও সন্ধি:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইহুদীদেরকে মদীনার ন্যায় খায়বর হতেও নির্মূল করতে চেয়েছিলেন এবং সেমতে কাতীবাহর ইহুদীরা সবকিছু ফেলে চলে যেতে রাযীও হয়েছিল। কিন্তু ইহুদী নেতারা এক পর্যায়ে রাসূলের নিকটে আবেদন করল যে, আমাদের এখানে থাকতে দেওয়া হৌক, আমরা এখানকার জমি-জমা দেখাশুনা ও চাষাবাদ করব ও আপনাদেরকে ফসলের অর্ধেক ভাগ দেব।
এখানকার যমীন সম্পর্কে আমাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আপনাদের চেয়ে বেশী রয়েছে’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের এ প্রস্তাব বিবেচনা করলেন এবং উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ প্রদানের শর্তে রাযী হলেন। সেই সাথে বলে দিলেন যতদিন তিনি চাইবেন, কেবল ততদিনই এ চুক্তি বহাল থাকবে। প্রয়োজনবোধে যেকোন সময় এ চুক্তি তিনি বাতিল করে দিবেন। অতঃপর উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে দায়িত্ব দেন।
গণীমত বণ্টন:
খায়বরের যুদ্ধে ভূমি সহ বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যার অর্ধেক অংশ ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য রেখে দিয়ে বাকী অর্ধেক ১৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়। হোদায়বিয়ার ১৪০০ সাথীর মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্য অংশ নির্ধারিত ছিল। এদের মধ্যে ২০০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। প্রত্যেক পদাতিকের জন্য একভাগ ও ঘোড়ার জন্য দু’ভাগ।
এক্ষণে ১২০০ পদাতিকের জন্য ১২০০ ভাগ এবং ২০০ অশ্বারোহীর জন্য ৬০০ ভাগ, সর্বমোট ১৮০০ ভাগে গনীমত বণ্টন করা হয়। উক্ত হিসাবে আল্লাহর রাসূলও একটি ভাগ পান।
ফুটনোট:
[1] বুখারী হা/৪১৯৬; মুসলিম হা/১৮০২।
[2] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩০৩।
[3] ওয়াকেদী, মাগাযী পৃঃ ২১২।
[4] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩২৯ হাদীছ ছহীহ, সনদ মুরসাল।
[5] মানছূরপুরী বলেন, প্রথমে মাহমূদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পরপর পাঁচদিন অভিযান ব্যর্থ হবার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত কথা বলেন এবং আলীকে দায়িত্ব দেন (রাহমাতুল ১/২২০-২২২)। কিন্তু মুবারকপুরী এতে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং অধিকাংশ বিদ্বানের নিকটে গৃহীত মত হিসাবে বইয়ে প্রদত্ত বক্তব্য পেশ করেন।
[6] বুখারী হা/৪২১০।
[7] বুখারী হা/৩৮৭৫, ৫৬৮২, ৬৩৮৩; মুসলিম হা/৩৩৮৩।
[8] মুসলিম হা/১৮০৭।
[9] যাদুল মা‘আদ ৩/২৮৭।
[10] আবুদাঊদ হা/৩০০৬, সনদ হাসান।
[11] বুখারী হা/৪২১১।
[12] যাদ ২/১৩৭; ইবনে হিশাম ২/৩৩৬।
[13] বুখারী হা/৩১৬৯; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button