মহানবী (সাঃ) এর জীবনী
বদর হ’তে ওহোদ
বদর হ’তে ওহোদ
(২হিঃ ১৭ই রামাযান হ’তে ৩হিঃ ৭ই শাওয়াল)
বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহুদী ও মুনাফিকেরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে। এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা নিম্নে সংক্ষেপে উদ্ধৃত হল-
(১) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র:
বদর যুদ্ধে গ্লানিকর পরাজয়ে এবং শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে কুরায়েশরা যখন ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহারা, তখন এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অন্যতম নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বদর যুদ্ধের সামান্য পরে একদিন কা‘বা গৃহের রুকনে হাতীমে বসে ওমায়ের বিন ওহাব আল-জামহীর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করল যে, তুমি তোমার ছেলেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে হত্যা করবে। বিনিময়ে আমি তোমার যাবতীয় ঋণ পরিশোধের ও তোমার পরিবার পালনের দায়িত্ব নিচ্ছি।
উল্লেখ্য যে, ওমায়ের-এর পুত্র ওহাব বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে মদীনায় ছিল। দুজনের মধ্যে এই চুক্তি হওয়ার পরে এবং তা সম্পূর্ণ গোপন রাখার শর্তে ওমায়ের বিন ওহাব ভালভাবে বিষ মাখানো একটা তরবারি নিয়ে মদীনায় গিয়ে হাযির হল। হযরত ওমর (রাঃ) তাকে ঘাড় ধরে রাসূলের কাছে নিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ছেড়ে দিতে বললেন।
অতঃপর ওমায়ের তাঁর নিকটে এসে আরবদের রীতি অনুযায়ী বলল, ‘সুপ্রভাত’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ আমাদেরকে এর চাইতে উত্তম অভিবাদন রীতি প্রদান করেছেন অর্থাৎ সালাম, السلام عليكم যা হল জান্নাতীদের অভিবাদন (ইউনুস ১০/১০)।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে তার ছেলের মুক্তির জন্য রাসূলের সহানুভূতি কামনা করল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাহলে তরবারি কেন এনেছ? সে বলল, এর ধ্বংস হৌক। এটা কি আমাদের কোন কাজে লেগেছে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বারবার সত্য কথা বলার তাকীদ দিলেও সে চেপে যায়। তখন তিনি মক্কায় তাদের দুজনের মধ্যকার গোপন শলা-পরামর্শের কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক হয়ে গেল। অতঃপর কলেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে উত্তম রূপে দ্বীন ও কুরআন শিখতে বললেন এবং তার ছেলেকে মুক্তি দিলেন। কিছুদিন পর সে রাসূলের অনুমতি নিয়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করল এবং সেখানে তার হাতে অনেকে মুসলমান হল। ছাফওয়ান শপথ করল যে, তার সঙ্গে কখনো কথা বলবে না এবং তার কোন উপকার করবে না। অবশ্য ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর ছাফওয়ান মুসলমান হয়ে যান।
(২) ইহুদী চক্রান্ত:
কয়েকটি নমুনা
(ক) মক্কার কাফেরদের প্রদত্ত নানাবিধ অপবাদের ন্যায় মদীনার ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রা‘এনা (راعنا) বলে ডাকতে থাকে। আরবী ভাষায় যার অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধানকারী’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ। এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করতে চাইত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের হিব্রু ভাষা অনুযায়ী راعينوا অর্থাৎ شريرنا ‘আমাদের দুষ্ট ব্যক্তিটি’ অর্থ গ্রহণ করত। তাদের এই চালাকি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক এটাকে নিষিদ্ধ করে ‘উনযুরনা’ (انظرنا) অর্থাৎ ‘আমাদের দেখাশুনা করুন’- লকবে ডাকতে নির্দেশ দিলেন (বাক্বারাহ ২/১০৪)।
(খ) ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন যে, শাস বিন ক্বায়েস (شاس بن قيس) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহুদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে গমন করছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল।
কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহুদী গোত্রগুলি।
ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহুদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে ইতিপূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রীয় ছাহাবীদের মধ্যে লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الحرة) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السلاح السلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটি শয়তানী প্ররোচনা (نزغة من الشيطان) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহুদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল।
ওহোদ যুদ্ধ:
বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের জান নিয়ে পালিয়ে আসার গ্লানিকর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার পথ ছেড়ে নাজদের পথ ধরে সিরিয়া যাত্রী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাষ্কর পরিণতির প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে।
সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলের, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালের মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। যার বিক্রয়লব্ধ মাল ও অর্থের পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা। এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয়,
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ-
আল্লাহর রাস্তা হ’তে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধনসম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’ (আনফাল ৮/৩৬)।
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
অতঃপর যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু ওয়ালীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হলেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূলের হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন।
মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের উক্ত পরামর্শ বৈঠকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথমে নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি’। আমি দেখি যে, কতগুলি গরু যবেহ করা হচ্ছে। দেখি যে, আমার তরবারির মাথায় কিছুটা ভগ্নদশা। আরো দেখি যে, আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছি’। এর ব্যাখ্যা এই হ’তে পারে যে, আমার কিছু ছাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হবে। তরবারির মাথা ভাঙ্গার অর্থ আমার পরিবারের কেউ নিহত হবেন।
আর সুরক্ষিত বর্ম অর্থ মদীনা সুরক্ষিত থাকবে। অতঃপর যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি প্রথমে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে। অতঃপর উপরোক্ত প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত তলব করলে একদল বুযর্গ ছাহাবী , বিশেষ করে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাঁরা দ্রুত বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমরা তো এদিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করছিলাম। আজ সেটা আমাদের কাছে এসে গেছে এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছে।
অতএব ‘আপনি শত্রুদের দিকে বের হউন। যাতে তারা আমাদেরকে কাপুরুষ ও দুর্বল বলে ধারণা করতে না পারে’। রাসূলের চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, যিনি বদর যুদ্ধে নিজের তরবারির চমক দেখিয়েছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, ‘সেই সত্তার কসম! যিনি আপনার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন। আমি খাদ্য গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না আমি মদীনার বাইরে গিয়ে আমার তরবারি দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’। আনছারদের বাকী প্রায় সবাই বললেন, আমরা জাহেলী যুগে বাইরে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতাম।
এখন ইসলামী যুগে আমরা বাইরে গিয়ে মুকাবিলার অধিক হকদার। অতএব শত্রুদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাঁর পূর্বমত পরিবর্তন করলেন এবং অধিকাংশের মত অনুযায়ী (رأي الأغلبية) মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর একটি জানাযা শেষে পোষাক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এতে ছাহাবীগণ লজ্জিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে বাধ্য করতে চাই না। আপনি চাইলে মদীনাতে থেকেই যুদ্ধ করুন। কিন্তু তিনি বললেন, কোন নবীর জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পর তা খুলে ফেলেন’।
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বৈষয়িক ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া আমীরের জন্য সঙ্গত। এর পরেও তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। বরং তাঁর সিদ্ধান্ত সকলকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। তবে বিধানগত বিষয়ে অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া বৈধ নয়’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)।
শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনী দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ৩০০ জনকে অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনা দলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে, ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, ‘রাসূল (সাঃ) তার কথা পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’।
অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টি করা, যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রু সেনারা যাতে পিছন দিক হ’তে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি পূর্ব-দক্ষিণের সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’ (جبل الرماة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত।
তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক না কেন, তারা যেন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান পরিত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এমনকি আমাদের মৃত লাশে যদি পক্ষীকূল ছোঁ মারতে থাকে, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান পরিত্যাগ করবে না। অথবা আমরা বিজয়ী হয়ে যদি গণীমত কুড়াতে থাকি, তথাপি তোমরা তাতে শরীক হবে না’। فلا تبرحوا حتى أرسل إليكم ‘অতএব তোমরা হটবে না, যতক্ষণ না আমরা তোমাদের ডেকে পাঠাই’। [4] কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হলে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন।
তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হলেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তিনি শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান পার্শ্বের এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম পার্শ্বের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন।
মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন ওয়ালীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাগণকে সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন।
কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল:
(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় করলেন।
(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিল ‘আবু আমের’ আর-রাহিব। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তার ধারণা ছিল যে, সে ময়দানে উপস্থিত হলে আনছাররা ফিরে যাবে।
সেমতে সে ময়দানে এসে আনছারদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়ে তাদেরকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা কিছুটা আঁচ করা যায়।
যুদ্ধ শুরু:
৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের মত এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি দেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন, ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হল যুবায়ের’।
প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর বংশের কুযমান ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক’। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।
মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীদের একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন, কে আছ আমার এই তরবারি তার হক সহ গ্রহণ করবে? আলী, যুবায়ের, ওমর সহ বহু ছাহাবী একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। কিন্তু এ সময় আবু দুজানাহ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি?
জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তুমি এর দ্বারা শত্রুদের মুখে মারবে, যাতে ওরা আমার থেকে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, ‘আমি এর হক আদায় করব হে আল্লাহর রাসূল’। তখন তিনি তাকেই তরবারি দিলেন। রাসূলের তরবারি হাতে পেয়ে আবু দুজানা খুশীতে আত্মহারা হয়ে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যান।
‘আমরা যখন খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম, তখন আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ আমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’। [5]
এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে শত্রু পক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম।
যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহলে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’।
ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তার দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে যাই’। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়। [7]
‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রু সেনাকে হত্যা করেন।[9]
কেবল আবু দুজানা ও হামযা নয়, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত মালামাল জমা করতে শুরু করল। [10]
তীরন্দাযদের ভুল ও তার খেসারত:
কাফিরদের পলায়ন ও গণীমত জমা করার হিড়িক দেখে গিরিপথ রক্ষী তীরন্দায দল ভাবল, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অতএব আর এখানে থাকার কি প্রয়োজন? গণীমতের মাল ও দুনিয়ার লোভরূপী শয়তান সাময়িকভাবে তাদের মাথায় চেপে বসল। ‘গণীমত’ ‘গণীমত’ বলতে বলতে তারা ময়দানের দিকে ছুটে চলল। অধিনায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের (রাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ১০ জন বাদে বাকী ৪০ জনের সবাই ছুটলো ময়দানের দিকে। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর ধুরন্ধর সেনাপতি খালেদ ইবনু ওয়ালীদ সুযোগ বুঝে নক্ষত্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঐ ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ও তাঁর সাথীগণ সকলে প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলেন।
অতঃপর খালেদ ও তার পশ্চাদবর্তী কুরায়েশ সেনাদল অতর্কিতে এসে অপ্রস্ত্তত মুসলিম সেনাদলের উপরে হামলা করল। ঐ সময় আমরাহ বিনতে আলক্বামা নাম্মী জনৈকা কুরায়েশ মহিলা তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তুলে ধরলে চারদিক থেকে মাক্কী বাহিনী পুনরায় ময়দানে ছুটে আসে এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হল মহা পরীক্ষা।
মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে মহা বিপর্যয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ সময় আহত হন। অতঃপর সুকৌশলে স্বীয় বাহিনীকে উচ্চভূমিতে তাঁর ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ফলে মুসলিম বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও সাক্ষাৎ পরাজয় থেকে বেঁচে যায়। তীরন্দাযদের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
ইবনু হাজার বলেন, বিদ্বানগণ বলেন যে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ নিহিত ছিল। যেমন-
(১) রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করা। কেননা তীরন্দাযগণের অবাধ্যতার ফলে আকস্মিক এই বিপর্যয় নেমে আসে
(২) রাসূলগণের জন্য সাধারণ নিয়ম এই যে, তারা প্রথমে বিপদগ্রস্থ হন এবং শেষে বিজয়ী হন। কেননা যদি তাঁরা সর্বদা কেবল বিজয়ী হ’তে থাকেন, তাহলে মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও ঢুকে পড়বে, যারা তাদের নয়। আবার যদি তারা কেবল পরাজিত হ’তেই থাকেন, তাহলে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হাছিল হবে না। সেকারণ জয় ও পরাজয় দু’টিই একত্রে রাখা হয়, যাতে প্রকৃত ঈমানদার ও কপট বিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। [11]
ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আক্বীদা:
ছাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ মা‘ছূম ছিলেন না। শয়তান সাময়িকভাবে হলেও তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে (আলে ইমরান ৩/১৫৫)। সেজন্য আল্লাহ পাক মাঝে-মধ্যে পরীক্ষায় ফেলে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেন, যেমন ওহোদের যুদ্ধে করেছেন। তবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছেন (আলে ইমরান ৩/১৫২) এবং তাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন (তওবা ৯/১০০)। তাদের বিশাল সৎকর্ম সমূহ ছোট খাট গোনাহ সমূহকে ধুয়ে ছাফ করে নিয়ে গেছে (হূদ ১১/১১৪)।
রাসূলের ভাষায় ‘ওহোদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করলেও ছাহাবায়ে কেরামের কোন একজনের (সৎকর্মের) সমপরিমাণ বা তার অর্ধেকও হবে না। [12]
ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, শাম বিজয় কালে সেখানকার নাছারাগণ ছাহাবীগণকে দেখে বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! এঁরা আমাদের হাওয়ারীদের চাইতে উত্তম’ ইবনু কাছীর বলেন, তারা সত্য কথাই বলেছিল। কেননা ছাহাবীগণ সম্পর্কে বিগত এলাহী কিতাব সমূহেও বর্ণনা রয়েছে। [13]
ফুটনোট:
[1] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৫১-৫৭; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৯১; ইরওয়া হা/১১৯১।
[2] ইবনু হিশাম ২/৬৩।
[3] ইবনু হিশাম ২/৬৬।
[4] বুখারী, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১/৪২৬, হা/৩০৩৯; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩।
[5] ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮।
[6] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৬০-৬১।
[7] ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২।
[8] ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী ৭/৪২৭।
[9] আল-ইছাবাহ, ২/২৮৬, ক্রমিক সংখ্যা ১১০২।
[10] বুখারী হা/৪০৪৩, ২/৫৭৯।
[11] যাদুল মা‘আদ ২/৯৯-১০৮; ফাৎহুল বারী ৭/৩৪৭ পৃঃ।
[12] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮।
[13] ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফাৎহ ২৯ আয়াত।